ছুটির কৌতুক

ছুটির কৌতুক Holiday
Hits: 19
আমার বাবা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন আসানসোলের একগ্রামে। গ্রামের নাম ছিল কন্যাপুর। আমার বয়স তখন আট। আমরা সপরিবারেই থাকতাম বাবার কর্মস্থলেই। স্কুলের কোয়াটার ছিল। শুধু আমরাই নই , ঐ স্কুলের সব দিদিমনি মাস্টার মশাই-রাও থাকতেন। স্কুল কোয়াটার থেকে স্কুল ছিল একটু দূরে মানে গ্রামের একটু ভিতরে। একটাই স্কুল গ্রামে। তবে কোয়াটার ছিল মেন রাস্তার পাশেই। কোয়াটারের বেশ দূরে ছিল একটা ফ্যাক্টারী। সাইকেল ফ্যাক্টারী, নাম র্যালে। ফ্যাক্টারীর চারপাশে ফ্যাক্টারীর কোয়াটার ছিল। স্কুলটা ছিল ঐ ফ্যাক্টারীরই। বেসিক স্কুল। নানারকম শিল্পকর্ম শেখানো হত তারসাথে পড়াশোনাও। আমার বাবা ছিলেন সংস্কৃতর মাস্টার মশাই। আমাদের পরিবারে আমরা ছিলাম বাবা, মা, দাদা, দিদি আর আমি। আমার দাদা ছিল ঐ স্কুলের পিয়ন।
যাই হোক যে কারণে এই গল্প লেখা সেটাই বলি। আমি তখন ক্লাস ফোর-এ পড়ি দিদি সেভেন। আমাদের স্কুলে ক্রাফটের টিচার ছিলেন কিন্তু সেলাইর টিচার ছিলেন না। মাস খানেক পরে একজন সেলাই-এর টিচার এলেন। কিন্তু তিনি প্রতিবন্ধি। তাঁর ডান হাত ছিল না। ছিল না বললে ভুল বলা হবে। ছিল তবে জোর ছিল না। যাবতীয় কাজ তিনি বাঁ হাতেই করতেন এবং খুব সুন্দর করে করতেন। সবাই অবাক হয়ে যেত। ছোট্টোখাট্টো রোগা পাতলা ছিল চেহারা। সদাই হাসি মুখ। আমাকে দিদিকে খুব ভালোবাসতেন। আমরাও ‘শিল্প দিদিমনি’ বলে ডাকতাম। যখন উনি এলেন একাই এলেন। আমার মা জিজ্ঞাসা করলে, বললেন – “আমার মা জানুয়ারী মাসে আসবেন। মা ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি এসে সব দেখে শুনে মাকে চিঠি লিখবো।”
“মা কার কাছে আছেন এখন ?” আমার মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে উত্তরে শিল্প দিদিমনি বলেন, – “আমাদের গ্রাম মেদিনীপুর। ওখানে এক জ্ঞাতির বাড়িতে মা আছেন। কিন্তু জানেন বৌদি, মাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা।”
– “কেন মা খুব বুড়ো মানুষ না কি ?”
– “হ্যাঁ একটু তো বুড়ো বটেই। সে জন্য নয় মা খুব খাটিয়ে।”
-“তবে ?”
– “আমরা বাঙাল তার ওপর মেদিনীপুরী ভাষা। আমি নানা কাজের সূত্রে কলকাতা যাতায়াতে মানুষ জনের সঙ্গে মিশি, ও দেশীয় ভাষার পরিবর্তে এ দেশীয় ভাষা বলি তাও মাঝে মাঝে মেদিনীপুরী টান আসে। কিন্তু আমার মায়ের ভাষা চট করে কেউ বুঝতে পারে না। তার ওপর মা খুব তাড়াতাড়ি কথা বলে। এখানে এলে কি হবে কে জানে। কানেও একটু কম শোনেন। কি করবো তাই ভাবছি। শুধু এই – কোন পুরুষ মানুষ দেখলেই লম্বা ঘোমটা দেয়।” হাসলেন দিদিমনি।
– “তা আগেকার মানুষ তাই ওমন করেন। ও নিয়ে তুমি ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে।” মা চলে গেলেন। শিল্প দিদিমনিও ঘরে ঢুকে গেলেন।
আমি শুনে তো অবাক হয়ে গেলাম। এ আবার কি রকম মানুষ।
যাই হোক ক্রমে ক্রমে জানুয়ারী মাস এল। হঠাৎ একদিন স্কুলে চিঠি এল, আমাদের রাজ্যের শিল্প মন্ত্রি আসছেন ‘র্যালে সাইকেল ফ্যাক্টারী’ দেখতে সেই সঙ্গে স্কুলও পরিদর্শন করে যাবেন, ২৬শে জানুয়ারী।
ব্যাস স্কুলে সাজো সাজো রব পরে গেল। সাজানো গোছানো করো, রং করো, সাফসাফাই করো, বাপ্ রে বাপ্।
আজ সবে জানুয়ারীর ৬ তারিখ এখনো ২০ দিন দেরী কিন্তু আমাদের স্কুলে এমন অবস্থা সব মাস্টারমশাই সব দিদিমনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যেন কাল বাদে পরশু মন্ত্রি আসছেন। আলাপ আলোচনা জল্পনা কল্পনার আর বিরাম নেই। সব থেকে ব্যস্ত আমাদের শিল্প দিদিমনি। সকালে স্কুলে যান আসেন ভর দুপুরবেলা কোন রকমে দুটো রান্না করে খেয়ে আবার স্কুলে যান আসেন সেই সন্ধ্যেবেলা।
এমতো অবস্থায় শিল্প দিদিমনির মা আমোদিনী বালা এলেন জানুয়ারীর ২০ তারিখে।শিল্প দিদিমনি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাই হোক দুটো তো রান্না ভাত পাবেন। ক্রমে ক্রমে সেই দিন এসে গেল। আজ ২৫শে জানুয়ারী কাল ২৬শে জানুয়ারী। কাল মন্ত্রী আসবেন।
আজ আমরা সবাই স্কুলের সব ছাত্র ছাত্রী মাস্টার দিদিমনি সন্ধ্যে অবধি স্কুলে। একদল রঙিন কাগজের পতাকা, শিকলি করে টাঙাছে কেউ কেউ ভালো ভালো ফুলের টব এনে স্কুল বাউন্ডারী সাজাচ্ছে। শিল্প দিদিমনির সঙ্গে আমরা স্কুল চাতালে চাল, ডাল, কালোজিরে ইত্যাদি দিয়ে বিরাট একটা আল্পনা করতে ব্যস্ত। কোন দল কুচকাওয়াজ করবে, কোন দল অভ্যর্থনায় থাকবে কি খাবার দাবার আসবে, কে আনতে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ ২৬ শে জানুয়ারী। বেলা দশটার সময় মন্ত্রি মহাশয় এলেন। সঙ্গে কত পুলিশ, কত লোক, দুটো পুলিশের গাড়ি। তিনটে সাদা মোটর গাড়ি, দুটো জিপ গাড়ি। সব আমাদের কোয়াটারের পাশে একটা ছোট মাঠ আছে সেখানেই সব দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি গাড়ির সঙ্গে দুটো তিনটে করে পুলিশ আছে। আমাদের কোয়াটার প্রায় ফাঁকা। শিল্প দিদিমনি আমার মাকে বলে গেছেন “বৌদি আমার মাকে একটু দেখবেন।”
তাই মা ১১টার সময় রান্না করতে করতে দিদিমনির ঘরে উঁকি দিতে এসে দেখেন ঘর বন্ধ। মা ভাবলেন দরজা বন্ধ করে ভেতরে স্নান করছেন বোধ হয়। মা গিয়ে রান্নায় মন দিলেন। আমি আর দিদি ফিরলাম ১২:৩০ মিনিটে মা বললেন – “দেখে আয় ঠাকুমাকে।” দেখে এসে মা কে বললাম – “মা ঠাকুমা বোধ হয় ঘুমাচ্ছে। দরজা বন্ধ, ডাকলাম খুলল না।”
মা বললেন – “সেকি রে এখন ঘুমাবে কি। এখন রান্না বান্নার সময়।” বলে মা গিয়ে জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিলেন কড়া নাড়লেন। না কোন সাড়া নেই। চিন্তিত মুখে মা এসে রান্না বন্ধ করে আমায় বললেন – “যা ছুটে স্কুলে গিয়ে দিদিমনি কে ডেকে নিয়ে আয়।” একছুট দিলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে দিদিমনিকে বললাম, – “দিদিমনি, শিগির চলুন। আপনার মা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আর সাড়া শব্দ দিচ্ছে না।” শিল্পদিদি তো শুনে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। দিদিমনির আশে পাশে যাঁরা ছিলেন অন্যান্য মাস্টার মশাই দিদিমনিরা, আমার দাদা স্কুলের দারোয়ান এমন কি সুইপারটাও পর্যন্ত শিল্পদিদিমনির সঙ্গে ছুটতে ছুটতে কোয়াটারে এসে হাজির। ততক্ষনে কোয়াটারের আশেপাশের অনেক লোক জমে গিয়েছে। এমন কি মন্ত্রী মহাশয়ের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ গুলো পর্যন্ত কোয়াটারের গেটে হাজির হয়েছে। শিল্পদিদিমনি ছুটে এসেই দরজায় ঘা দিলেন – “মা, অ-মা, দরজা খুইলা দাও। সাড়া নাই ক্যান তুমার ? মা, অ-মা।” না দরজা আর খোলে না। সাড়াও দেয় না। তারপর সবার খেয়াল পড়ে ঘরের ভেতর থেকে দরজা মাথার জানালা দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। আর পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে। ব্যস সবাই হইহই করে উঠল – “আরে কি হল, এত ধোঁয়া কেন ? দমকল ডাকো, দরজা ভাঙ্গ – ” ইত্যাদি ইত্যাদি।তখন কয়েক জন মাস্টার মশাই আমার দাদাকে বললেন, – “এই রবি তুই দরজার ওপরের জানলার শিকটা খুলে ভিতরে ঢুকে দরজার ছিটকানিটা খুলে দে – যা তাড়াতাড়ি কর।” আমার বাবা ততক্ষনে মেইন সুইচটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দাদা তো একেই ভীতু মানুষ। সে এই সব দেখেশুনে ঠক ঠক করে কাঁপছে। তার ওপর মাস্টার মশাইরা ঐ রকম ভাবে দরজার মাথায় উঠে জানালার শিক খুলে ভেতরে ঢুকতে বলায় ও কেঁদে ফেলল। কি করবে ভয়ে ভয়ে লম্বা টুলে উঠে জানালার বাইরের দিকে শিকটা খুলে মাথাটা গলিয়ে ঢুকেছে। কিন্তু বুকের পর থেকে আর ঢুকছে না আটকে গেছে। কেননা ভিতরের শিকটা খোলে নি। ঘরে ধোঁয়ায় ভর্তি কিছু দেখতে পাচ্ছে না। দাদার মাথা আর দুটো হাত ভেতরে, বাইরে পেট আর দুটো পা ঝুলছে। বেচারা যেন হাওয়ায় হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটছে।
– “ও মা আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কিছু ধরতেও পাচ্ছি না। পড়ে গেলে মাথা ফেটে যাবে। ও মাগো আমি পাচ্ছি না। ও – মা।”
মা তো দাদার কান্না শুনে মাও কাঁদছে। দিদি কাঁদছে। সব দিদিমনিরাও কাঁদছেন। বাবা তখন দাদা পা দুটো ধরে বললেন, – “এই চেঁচাস নি, একটু থাম। আমি তোকে ধরে আছি পড়বি না। আমার কথা শোন্। তুই হাত বাড়িয়ে দরজার মাথার ছিটকানিটা খুলে দে, আমরা নিচে থেকে খিল খুলছি। বাবার গলা শুনে দাদা একটু শান্ত হল। হাঁতড়ে হাঁতড়ে দরজার ছিটকানি খুলে দিল। তারপর বাবার সাহায্যে আস্তে আস্তে নেমে এল। আসার পর পাতলা শিক ঢুকিয়ে খট করে খিলটাও খুলল সবাই। দরজা খুলে যেতেই হুড়মুড় করে কয়েকজন, শিল্পদিদিমনি সবাই ঘরে ঢুকলেন। দরজা খুলতে ধোঁয়াও কমল। হিটারে দুধ চাপানো ছিল। তা উথলে পড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে বাটি। মেইন সুইচ অফ হতে তা রক্ষা পেয়েছে। জানি না কি হত। কিন্তু কই শিল্পদিদিমনির মা কই। সারা ঘরে তো উনি নেই। এদিকে আবার ভেতর থেকে খিল ছিল, তবে – সবাই উঁকি দিয়ে চৌকির তলায় দেখেন শিল্পদিদিমনির মা চৌকির তলায় ঘুমাচ্ছেন। এত চিৎকার চেঁচামেচিতেও ওঁনার ঘুম ভাঙ্গে নি।
শেষ কালে শিল্পদিদিমনি গ্লাস করে জল এনে গায়ে ছিটিয়ে দিতে ওঁনার ঘুম ভাঙ্গল। ধরমর করে উঠে বসেন। এত লোক দেখে জিভ কেটে এক গলা ঘোমটা টেনে দিলেন মাথায়। সবাই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। শিল্পদিদিমনি ওনাদের দেশীয় ভাষায় কি জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর কথার উত্তরে উনিও কি যেন বললেন সলজ্জে। তার মর্ম হল, – ‘এই একটু চোখটা লেগে এসে ছিল।’ আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। ‘এর নাম চোখ লাগা।’ বাপরে, –
Very nice. Arokom Aro chai….
গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগলো… আশা রাখছি এই রকম আরো কিছু গল্প দেখতে পাবো..
ধন্যবাদ
khub valo laglo golpo ta pore.
Khub Sundor golpo ta👍
Golpo ta khub sundor…
Besh bhalo..👍
Khub bhalo laglo
Khub sundor👍
Besh bhlo 👍
Golpo ta khub mone laglo ,, aro arom ki6u golpo post kora hok
Kub valo golpo ta