অচেনা বীরাঙ্গনা
Views: 3
অচেনা বীরাঙ্গনা:
সালটা ছিল ১৯২৫, এক বর্ষার সকাল। বাংলার এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম নেয় এক শিশু কন্যা। তার বাবা ছিলেন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক, আর মা ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল অসাধারণ মেধাবী ও জিজ্ঞাসু। তার বাবা তাকে পড়াশোনায় উৎসাহিত করতেন, যা সেই সময়ে মেয়েদের জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল না।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন হতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার, দেশের মানুষের দুর্দশা, তাকে ভাবিয়ে তুলত। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে সে দেখল, কিছু ছাত্র-ছাত্রী মিছিল করছে। তাদের হাতে ব্যানার, মুখে স্লোগান – “ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ো”(onekjon)। সেই দৃশ্য তার মনে গভীর ছাপ ফেলে।
কিশোরী বয়সে সে প্রথম জানতে পারে স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা। তার বাবার এক বন্ধু, যিনি গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন। সে লুকিয়ে সেসব আলোচনা শুনত। ধীরে ধীরে তার মনেও জাগ্রত হতে থাকে দেশপ্রেমের অনুভূতি।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তার জীবনে আসে বড় পরিবর্তন। সেখানে সে পরিচিত হয় কয়েকজন বিপ্লবী ছাত্র-ছাত্রীর সাথে। তারা তাকে একটি গোপন সংগঠনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমে সে দ্বিধায় ছিল, কিন্তু দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ তাকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
সংগঠনে যোগ দেওয়ার পর তার জীবন দ্বিমুখী হয়ে ওঠে। দিনের বেলায় সে মেধাবী ছাত্রী, আর রাতের অন্ধকারে পরিণত হয় এক সাহসী বিপ্লবীতে। সে লিফলেট বিতরণ করে, গোপন বৈঠকে যোগদান করে, এমনকি অস্ত্র পাচারের কাজেও সাহায্য করে। তার বুদ্ধিমত্তা ও সাহস দেখে সংগঠনের নেতারা মুগ্ধ হন।
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে সে সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করে। সে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করার জন্য বক্তৃতা দেয়, মিছিলে নেতৃত্ব দেয়। একবার পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয় তাকে।
১৯৪৩ সালের এক ঘটনা তার জীবনে আনে বড় পরিবর্তন। সংগঠনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সেই সদস্যের কাছে ছিল সংগঠনের অনেক গোপন তথ্য। পুলিশ তাকে নির্যাতন করে সেই তথ্য বের করার চেষ্টা করছিল। এই খবর পেয়ে আমাদের নায়িকা এক সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়। সে নিজেকে পুলিশের কাছে সমর্পণ করে এবং মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেয় যে সেই গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি নির্দোষ, আসল অপরাধী সে নিজে।
কারাগারে বন্দী অবস্থায় সে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। দিনের পর দিন তাকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। কিন্তু তার দৃঢ় মনোবল ভাঙ্গতে পারে না কেউ। সে কোনো তথ্য প্রকাশ করে না। তার এই সাহসিকতায় অন্য বন্দীরাও অনুপ্রাণিত হয়।
ছয় মাস পর যখন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, তখন সে শারীরিকভাবে দুর্বল কিন্তু মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী। জেল থেকে বের হয়ে সে দেখতে পায় তার ত্যাগ বৃথা যায়নি। তার সংগঠন সুরক্ষিত রয়েছে এবং আরও শক্তিশালী হয়েছে।
মুক্তির পর সে আরও বেশি উদ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার সে শুধু নিজের গ্রাম বা শহরেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সারা বাংলা জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে সচেতন করে, স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
১৯৪৬ সালে যখন দেশব্যাপী দাঙ্গা শুরু হয়, তখন সে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য কাজ করে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের বার্তা ছড়ায়। একবার এক দাঙ্গা কবলিত এলাকায় গিয়ে সে নিজের জীবন বিপন্ন করে একটি মুসলিম পরিবারকে রক্ষা করে।
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। ভারত স্বাধীন হল। সেদিন সকালে যখন সে প্রথম তিরঙ্গা পতাকা উড়তে দেখল, তার চোখ ছলছল করে উঠল। মনে পড়ল সেই সব দিনের কথা যখন সে এই মুহূর্তের জন্য লড়েছিল, কষ্ট সহ্য করেছিল। কিন্তু সেদিন তার মনে হল, সব কষ্ট সার্থক হয়েছে।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর অনেকেই তাকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করে। তার কাছে দেশসেবার অর্থ ছিল মানুষের কল্যাণে কাজ করা। তাই সে ফিরে যায় তার গ্রামে।
গ্রামে ফিরে সে শুরু করে নতুন লড়াই। এবার তার লক্ষ্য ছিল শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা। সে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। গ্রামের মেয়েদের পড়াশোনার জন্য উৎসাহিত করে। শুধু তাই নয়, মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য সে একটি কুটির শিল্প প্রকল্পও শুরু করে।
বছরের পর বছর ধরে সে এই কাজ করে যায়। তার প্রচেষ্টায় গ্রামের চেহারা পাল্টে যায়। মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করে, মহিলারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। তার কাজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবার তার লড়াই ছিল মানবতার জন্য। সে সীমান্ত এলাকায় শরণার্থী শিবির গড়ে তোলে। হাজার হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়, খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
বৃদ্ধ বয়সেও তার কর্মস্পৃহা কমেনি। নব্বই এর দশকে যখন পরিবেশ দূषণ একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু করে। তার প্রচেষ্টায় গ্রামের চারপাশে গড়ে ওঠে সবুজ বনানী।
২০১৫ সালে, নব্বই বছর বয়সে যখন তাকে একটি জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়, তখন সে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তার যুক্তি ছিল,
-“আমি যা করেছি, তা আমার দেশের জন্য। এর জন্য কোনো পুরস্কার প্রয়োজন নেই।”
২০২০ সালে, ৯৫ বছর বয়সে তার জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর আগে তার শেষ কথা ছিল,
-“নিজের দেশকে ভালোবাসো, মানুষকে ভালোবাসো।”
তার মৃত্যুতে সারা দেশ শোকাহত হয়। হাজার হাজার মানুষের যেখানে তার শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতির জন্য গুটি কয়েক মানুষই তার দাহ কার্য সম্পন্ন করে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল যে, তিনি যে আদর্শের জন্য লড়েছিলেন, তা তার মৃত্যুর পরেও জীবন্ত থেকে গেল। তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কুটির শিল্প প্রকল্প, বৃক্ষরোপণ অভিযান – সবই চলতে থাকল নতুন প্রজন্মের হাত ধরে।
আজ যখন আমরা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করি, তখন শুধু একজন নয় বহু নাম না জানা বিপ্লবীর কথা মনে রাখা উচিত।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Olivia Das |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Debanshu Ghosh |
Characters | Name |
---|---|
Freedom Fighter | Kaberi Ghosh |
Song | Joydeep Lahir, Olivia Das, Souradip Roy, Debanshu Ghosh |
Others | Surojit Das, Soumen Sadhukhan, Joydeep Lahir, Olivia Das, Debanshu Ghosh |
Find us on Facebook – click here