আত্মার সাথে এক রাত
Views: 0
আত্মার সাথে এক রাত:
আত্মা অবিনশ্বর। এটাতো আমরা কম বেশি সবাই শুনেছি। কিন্তু আত্মা কি করতে পারে, বা, তার কি ক্ষমতা থাকে ? সেটা একটা সাধারণ মানুষ হয়ে বলা বা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আত্মা কি মানুষের শরীর ধারণ করতে পারে? মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
সত্যি বলতে আমি জানিনা। শুধু একটা ঘটনার কথা বলছি। তার সত্যতার কথা আমি জানিনা, আর আপনাদেরও বলবো না বিশ্বাস করতে। শুধু শুনুন। কোন যুক্তি ব্যাখ্যা বা সাইন্টিফিক কারণ আমি দিতে পারবো না।
মৃত্যুর পর আমরা অনেক কিছুই, আচার, বিচার করে থাকি মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বা ওনার আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে। আমরা যতই ধর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করি না কেন, মৃত্যুর পর সবই এক। নানান আচার অনুষ্ঠান সমস্ত ধর্মের মধ্যেই থাকে।
যাইহোক এবার আসল গল্পে আসি। সনাতন দাস আমার বন্ধু বিশ্বজিৎ দাসের, পিসতুতো দাদা। বাড়ি আদ্রা, গোঘাট ব্লক, আরামবাগ সাব ডিভিশন, এবং হুগলি ডিস্ট্রিক্ট এর এক প্রত্যন্ত গ্রাম। পুরো ঘটনাটা বিশ্বজিতের মুখে শোনা, তাই এই ঘটনার সত্য বা মিথ্যা বিচার করার ভার আপনাদের। যা যা আমি শুনেছি তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
সেবারে পরীক্ষার শেষ হওয়ার পর বিশ্বজিৎ-রা অর্থাৎ বিশ্ব ও ওর বাবা মা বোন চারজনই পিসির বাড়ি আদ্রাতে ঘুরতে গিয়েছিল। দাদার পুরো নাম সনাতন দাস। বিশ্বরা ডাকত সনাদা বলে।
আসলে বিশ্বর বাবা বোনপোর শরীর খারাপের কথা শুনেই গিয়েছিল ওখানে। সঙ্গে বিশ্বর বাবা তার অফিসের বন্ধু কালীপ্রসন্ন ব্যানার্জি বাবুকে নিয়ে যান। গ্রামের বাড়িতে থাকেন পিসি, পিসিমশাই, বরদা সহদেব ও ছোটদা সনাতন। যখন গ্রামের বাড়ি পৌছায় ততদিনে সনাদার প্রায় মরো মরো অবস্থা। কি হয়েছে, সঠিক কেউ কিছু বলতে পারছিল না। স্থানীয় ডাক্তারও দেখিয়েছিল এমনকি ঝাড়ফুক, জলপড়া, তেলপড়া সবই প্রায় করেছিল। কিন্তু, কিছুতেই কিছু হয়নি। অসুখটা শুরু হয় জ্বর দিয়ে। প্রথমে ৩ – ৪ দিন খুব জ্বর আসে, ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেতেই, ধীরে ধীরে জ্বর কমেও যায়। কিন্তু, ঘাড়ে, কাঁধে প্রচন্ড ব্যথা মাথা ভার। এই সব কিছু কমেনি, একটু হাঁটাচলা করতে গেলেই পড়ে যাচ্ছে। কখনো সামনের দিকে অথবা কখনো পিছনের দিকে। তার মধ্যে মাঝে মাঝে চোখেও হালকা দেখছিল, ডাক্তার এর ওষুধ খেয়ে জ্বরটা প্রায় কমে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরেও বিশ্ব পিসি মন্দির, মসজিদ সব জায়গা থেকে কিছু না কিছু ঝাড়ফুঁক করতেই থাকে। কিন্তু কিছু না হওয়ায়, বিশ্বর পিসিমশাই বিশ্বর বাবাকে ফোন করে সবকিছু জানায়। যাতে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সোনাদার চিকিৎসা করাতে পারে।
এই ধরনের রোগের কথা সৌমজিৎ বাবু অর্থাৎ বিশ্বর বাবা প্রথম শোনেন। তাই তার কলেজের বন্ধু ও এখন অফিস কলিক কালী প্রসন্ন বাবুকে বলেন। কিন্তু দু একটা কথায় কালী প্রসন্ন বাবুর খটকা লাগায়, কোন খবর না দিয়ে আদরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় বিশ্বরা।
খটকা দুটি হলো, প্রথম, সেনাদার হটাৎ শরীরের ওজন আগের থেকে অনেক বেড়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় মাথা না ঘুরেই, টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাওয়া।
কালি প্রসন্ন বাবু কলকাতার অফিসে কাজ করেন ঠিকই কিন্তু তার সাথে তিনি একজন বড় তন্ত্রসাধক। তারাপীঠ থেকে তন্ত্র শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণ করেন। আধুনিক শিক্ষা ও তন্ত্র শিক্ষা দুটোতে সমান পাথর পারদর্শী। সেই কারণে আরো ওনাকে নিয়ে যান বিশ্বর বাবা। যেদিন বিশ্বরা গ্রামে পৌঁছায় সেদিন সন্ধ্যে থেকে সনাদের আবার তুমুল জ্বর আসে, তার সাথে ঘাড়ে, বুকে, মাথায়, প্রচন্ড ব্যথা ও যন্ত্রণা। ডাক্তারের ওষুধ খেয়েও ঘুম হচ্ছে না। জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকছে হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করেও উঠছিল, তার সাথে ঝটফট করেই চলেছিল, জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিল, তার সাথে তো গলা ফাটানো চিৎকার আর সেই চিৎকারে যেন পাশবিক। মাঝেমধ্যে গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। সনাদারকে ঘরের মেঝেতে শোয়ানো হয়েছিল। এত ছটফট করছিল, বিছানায় রাখলে যদি বিছানা থেকে পড়ে যায় তাই। কেউ সনাদার কাছে গেলেই আরো চিৎকার করেছে। সপ্তাখানেক আগে যখন জ্বর এসেছিল তখন এইরকম কিছু হয়নি বা করেনি। কিন্তু আজ যেন পুরো অন্যরকম লাগছে, সে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য চোখগুলো যেন ঠিকড়ে বেরিয়ে আসছে, যন্ত্রণায় শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে।
এইসব দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়। পিসি বিশ্বর মা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। বিশ্ব, বিশ্বর বোন ও সহদা পাশের ঘরে ভয় জরোসড়ো হয়ে বসেছিল আর যে ঘরে সনাদা ছিল সেই ঘরে শুধু কালী প্রসন্ন বাবু, বিশ্বর বাবা, ও বিশ্বর পিসেমশাই।
এইসব ঘটনা দেখে, শুনে পাড়ার সবাই বলতে থাকে ছেলেটাকে ভূতে ধরেছে। ওঝা ডাকতে হবে, এ ডাক্তারের কম্য নয়। তখন কেউই সনাদার হঠাৎ এই শরীরের অবনতির কারণ বুঝতে পারেনি। এমন সময় হঠাৎ-ই বাড়ির বাইরে বিশাল আওয়াজ। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই মেঘ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সনাদা-দেড় বাড়ির পাশে একটা বড় তালগাছে স্বশব্দে একটা বাজ পড়ে আগুন লেগে যায়।
তখনও কেউ কালী প্রসন্ন বাবুর পরিচয় এবং কাজের ক্ষমতা জানতো না। এই ঘটনার পর কালী প্রসন্ন বাবু বুঝে যান যে, উনার উপস্থিতি কেউ একজন মেনে নিতে পারছে না তাই উনাকে তাড়ানোর জন্যই এইসব করছে সে। আর বোঝা মাত্রই বাইরে জ্বলতে থাকা গাছে একটি পাতা দৌড়ে নিয়ে এসে সোনা দা যেখানে শুয়েছিল তার চারিদিকে ঘোরাতে থাকে এবং তারপর পকেট থেকে একটা লাল কাপড় মোড়া কিছু একটা সনাদার মাথার বালিশের নিচে গুঁজে দেয়। নিজের গলা থেকে পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মালা সনাদার গলায় পরিয়ে দেয় এবং পিসেমশাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন একটা পিতলের ঘটিতে গঙ্গাজল নিয়ে আসতে। পিসেমশাই গঙ্গাজল নিয়ে আসতেই, সেই জলের ঘটি হাতে নিয়ে কালীপ্রসন্ন বাবু কিছু মন্ত্র বলতে বলতে পকেট থেকে কিছু ছাই বার করে জলে মিশিয়ে দিয়ে। তারপর সেই জল সোনাদার গায়ের উপর সেটাতে থাকে এবং তার সাথে সাথে জোরে জোরে মন্ত্র আওড়াতে থাকেন আর এই সময় চিল চিৎকার করতে থাকে সনাদা। যেন কেউ বাঁশ দিয়ে তাকে মারছে। এই ঘটনার প্রায় আট থেকে দশ মিনিটের মাথায় সোনা দা চুপচাপ হয়ে যায় নেতিয়ে পরে।
তারপর কালী প্রসন্ন বাবু সোনাদার মাথার কাছে বসে আবার একটা মন্ত্র বলতে থাকেন। বেশ খানিকক্ষণ পর উপস্থিত সবাই দেখলো ঘটি থেকে কিছুটা জল বাইরে চলকে পরল। তার সঙ্গে সঙ্গেই একটা লাল কাপড় পকেট থেকে বার করে ঘটির মুখে বেঁধে দেয় কালীপ্রসন্ন বাবু। বাড়ির লোকজন পাড়া -প্রতিবেশীরা সবাই এতক্ষন দেখ যা ছিল কি ঘটছে ওখানে। সবই তাদের বুদ্ধির বাইরে। সবাই চুপ করে দেখে যাচ্ছিল যা ঘটে চলেছে।
এরপর কালী প্রসন্ন বাবু পিসেমশাই কে জিজ্ঞাসা করেন কাছে কোন নদী বা চলমান জলধারা আছে কিনা বা প্রতিষ্ঠা করা পুকুর। পিসেমশাই বলেন প্রতিষ্ঠা করা পুকুর আছে, সোনা মাত্রই এক মুহূর্ত দেরি না করি সেই দিকেই রওনা দিল কালী প্রসন্ন বাবু। হাতে লাল কাপড় বাঁধা সেই ঘটি, সাথে আলো হাতে বিশ্ব বাবা এবং কিছু গ্রামবাসী। তখন রাত প্রায় বারোটা বেজে গেছে রাস্তাঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার গ্রামবাসীরা টর্চ ও হ্যারিকেন না নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটাই যেত না। কালী প্রসন্ন বাবু বাঁধানো সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন, কিন্তু জলে নামলেন না। তারপর ঘটি টাকে জলে ডুবিয়ে লাল কাপড়টাকে খুলে পুকুরে ঘটি টাকে ভাসিয়ে দিলেন। আকস্মিক তখনই, পুকুরের পাশে থাকা একটা বড় গাছের ডাল ভেঙে জলে পড়ল। কি হলো কেউই বুজতে পারলো না। এদিকে কাজ মিটিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছালো গ্রামবাসীরা এবং কালীপ্রসন্ন বাবু, তখন সোনা দা ঘুমাচ্ছে এবং গা থেকে জ্বরও নেমে গেছে।
সেই রাতে আর তেমন কিছু ঘটেনি। তবুও, কালী প্রসন্ন বাবু ও বিশ্ব বাবা রাতে সনাদার ঘরেই ছিল। এবার পুরো ঘটনার উপর থেকে পর্দা ওঠার পালা। সকাল হতেই গ্রামবাসীরা এবং বাড়ির সবাই কালীপ্রসন্ন বাবু কে ঘিরে ধরে কি ঘটেছিল সবকিছু জানতে। ততক্ষণে সনাদাও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। এতদিন পর সোনাকে দেখে সম্পূর্ণ সুস্থ লাগছিল সবার। সনাদার গায়ের ব্যাথা, জ্বর কিছুই আর নেই।
কালী প্রসন্ন বাবু কিছু প্রশ্ন করেন সনাদাকে। তারপর সব গঠনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলতে থাকেন।
সেই দিন বিশ্বদের সব কথা শুনতে শুনতে গ্রামের সবাইয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল, তেমনি যখন বিশ্বর মুখে সব কথা শুনি, তখন আমারও গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিল। আর আজ হয়তো আপনাদেরও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে।
কালীপ্রসন্ন বাবু সনাদাকে প্রশ্ন করেন –
কালি – আচ্ছা সনাতন তোমার, কাল রাতের সব ঘটনা মনে আছে?
সনা- …না তো, কিছু মনে পড়ছে না। কাল বিকেলে আমাকে মা ওষুধ দিল, তারপর…. তারপর তো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভাঙলো সকালে।
কালি – সেটাই স্বাভাবিক। এবার আমায় বলতো তুমি কি, গত সপ্তাহ দুয়েক মধ্যে শ্মশানে গিয়েছিলে, বা তার আশেপাশে….!
সনা- হ্যাঁ, কিন্তু, আপনি কি করে জানলেন? এই কুড়ি বাইশ দিন আগে আমার স্কুলের এক বন্ধু পুকুরে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। ওকে দাহ করতেই আমরা বন্ধুরা মিলে ওর বাড়ির লোকের সাথে যাই, কিন্তু আমার সাথে তো অনেকেই গিয়েছিল, আর আমরা একসাথেই তো ছিলাম এবং একসাথেই বাড়ি ফিরি দাহ করে। তাহলে…. আমাকে কেন?
সনদের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করেন কালীপ্রসন্ন বাবু –
কালি – তুমি কি এমন কিছু করেছিলে যেটা অন্য কেউ করেনি? বা তোমার প্রতি তোমার মৃত বন্ধুর কোন রাগ ছিল বা কোন রকম মারামারি,ঝগড়াঝাটি হয়ে ছিল।
সনা- না কিচ্ছু না।
কালি -হুমমম। তুমি একটু বলো তো, সেই দিন ঠিক কি কি করেছিলে তুমি সেখানে?
সনা-সেদিন, (একটু ভেবে) আমরা তো খাটিয়ার পিছন পিছন যাচ্ছিলাম, আমরা পাঁচ সাত জন বন্ধু মিলে। ওখানে পৌঁছে ওর বাড়ির সবাই দাহ করার জন্য প্রস্তুত করতে থাকে এবং আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রায় ঘন্টা ৫ – ৬ পর দাহ শেষ হয়ে গেলে আমরা সবাই মাটির ঘটি করে নদী থেকে জল এনে সিতার আগুন ঠান্ডা করে দি। তারপর চিতায় একটা মালা দিয়ে, সবাই চলে আসি । আছে সময় কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে বন্ধু নিভে যাওয়া চিতার দিকে ঘুরে তাকাই এবং তখনই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে জলে।
কালি – সে কি? তারপর।
সনা- ও হ্যাঁ, ফেরার সময়ই দুবার রাস্তায় পড়ে যাই আমি এবং তারপর থেকেই কাঁধে ঘাড়ে ব্যথা হয়েছিল। তারপর দিন থেকেই জ্বর। বাবা ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার ওষুধ দেয়। কিন্তু বাবাকে ডাক্তারবাবু অবাকের সাথেই বলেন, এই ১৮-১৯ বছরের ছিমচম চেহারার ছেলের ওজন ৭৮ কেজি। ডাক্তার বাবু দুবার করে আমার ওজন মাপেন, তারপর কিছু বুঝতে না পেরে ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেন। আর তারপরের ঘটনা তো আপনি সবই জানেন।
এরপর সবাই কালীপ্রসন্ন বাবুর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন সবাই, তার উত্তর ও সমাধান পদ্ধতির কথা শোনার জন্য। খানিকক্ষণ চুপ থেকে মুখ খোলেন কালীপ্রসন্ন বাবু।
কালি -আমাদের হিন্দু শাস্ত্র মতে অনেক কিছু আচার, বিচার, প্রথা আছে। সেটা মৃত্যুর আগেই হোক বা পরেই, তার অন্যথা হলে অনেক কিছু অঘটন ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে তাই ঘটেছে সনাতনের সাথে। তার আগে আমি আমার পরিচয় দি। আমি কালী প্রসন্ন ব্যানার্জি, আমার বাবার নাম স্বর্গীয় শ্রী ঋষিকেশ ব্যানার্জী। আমি ছোট থেকেই তন্ত্রসাধনার সাথে যুক্ত। আমার বাবা তারাপিঠ থেকে দীক্ষা নিয়ে তন্ত্র সাধনা করতেন। বাবার সাথে আমিও নানা কাজে তাকে সাহায্য করতাম। একটু বড় হতেই, আমারও তন্ত্রসাধনায় আগ্রহ জাগে, সেই দেখে, বাবা আমাকেও তন্ত্রসাধনার দীক্ষা দেয়। এইসব আমার মায়ের, একদমই পছন্দ ছিল না। আমার বাবা অকালে প্রাণ হারান। আর তারপর থেকেই, মায়ের জন্য তন্ত্র সাধনা থেকে, দূরে ছিলাম। কিন্তু বন্ধুর এত বড় বিপদে ওর পাশে না দাঁড়ালে, যতটুকু তন্ত্র সাধনা শিখেছি তাও হয়তো ব্যর্থ হয়ে যেত।
যাগ্গে, এবার আসল কথায় আসি। যখন আকস্মিক ভাবে কারোর মৃত্যু হয়, বিশেষ করে তখন, সেই বিদেহী আত্মা, আবার শরীর ধারণ করতে চায়, অনেক কিছু বলতে চায়, করতে চাই। কিন্তু তখন সে কিছুই করতে পারে না। সব সময় তার বিদেহী দেহের আশেপাশে ঘুরতে থাকে, এমনকি শ্মশান পর্যন্ত দেহের সাথে সাথেই যায়। তখন বুঝতেই পারে না তার সাথে কি ঘটছে। কিন্তু যখন দেহকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে নানা মন্ত্রের মাধ্যমে দাহ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়, তখন সে বুঝতে পারে ইহজগতে আর তার ফেরা সম্ভব নয়। তারপর, তার সবথেকে প্রিয় দেহটাকে আগুনে পুড়তে দেখে, আত্মা আরও ছটফট করতে থাকে। তখন আত্মা, সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে, আবার শরীর ধারনের জন্য, কিন্তু, সেটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে শরীরের উপর ভর করা তার পক্ষে সম্ভব। কোন পরিচিত এবং রাস হালকা ব্যক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করতে আত্মা সক্ষম। আর সেই কারণেই কোন স্ত্রী লোককে দাহ করার সময় চিতার আশেপাশে থাকতে মানা করা হয়। দাহ করার পর একটা প্রথা আছে, পরিবারের পরিজনদের মধ্যে যারা পুরুষ আছে তারা মাটির ঘটি করে জল দিয়েছি চিতার আগুন ঠান্ডা করে, ঘটি চিতার দিকে মুখ না করেই মাটি বা পাথরে আঘাত করে ভেঙে ফেলে। তারপর চিতার দিকে না তাকিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় পরিবারের পরিজনরা। আত্মা তখনও চিতার পাশে কাঁদতে থাকে, পরিজনদের ডাকতে থাকে, তাকে, বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। চিতার আগুন বুঝিয়ে ঘটি ভেঙে ফিরে যাওয়ার কারণ মৃত ব্যক্তির প্রতি প্রিয়জনদের মায়া কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে। আর এই ভুলটাই করেছিল সনাতন। ও দাঁড়িয়ে পিছনদিকে দেখে, আর তখনই সম্ভবত ওর বন্ধুর অতৃপ্ত আত্মার সনাতনের উপর চেপে বসে। আমি দেখেছি সনাতনের রাস হালকা, এবং সনাতন যেহেতু মৃত ছেলেটির বন্ধু ছিল, তাই আত্মার প্রিয়জন।
আর চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়ার কারণ ওটাই। আমি নিশ্চিত, সনাতন যখনই পড়ে যেত তার আগে ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসতো। কি ঠিক তো সনাতন।
সনা- হ্যাঁ ঠিক বলেছেন তো।
কালি – ডাক্তারখানায় তোমার ওজন বাড়ার কারণটা তোমার ঘাড়ে , তোমার মৃত বন্ধুর আত্মা চেপে বসা। তোমার গায়ে ঘাড়ে কাঁধে ব্যথা হওয়ার কারণ সেটাই। (মুচকি হেসে বলেন) একজনের ঘাড়ে, অন্য একজন চেপে থাকলে কষ্ট তো হবেই।
কালীপ্রসন্ন বাবু পায়চারি করতে করতে, তিনি আরো বলতে লাগলেন-
কালি – আমি কলকাতায় সনাতনের কথা শুনেই একটা আঁচ করেছিলাম।
কিন্তু এখানে এসে মোটামুটি বুঝতে পারি, কিন্তু কিছু কিছু তথ্যের অভাবে সম্পূর্ণ ঘটনার কারণ বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু সনাতনের উত্তরএ সব জট খুলে গিয়ে, পুরো ঘটনা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
সম্ভবত আত্মাও আমার উপস্থিত বুঝতে পারে, আর সেই কারণেই নানা রকমের অঘটন ঘটাতে থাকে, আমাকে দূরে সরানোর জন্য। আর সেটা করতে না পেরে, সনাতনের উপর শারীরিক অত্যাচার করতে থাকে। আর আমি যদি এর পরও চুপ থাকতাম তাহলে হয়তো সনাতনের প্রাণহানি হতে পারত। আর এই ধরনের ঘটনায় সেটাই হয়। আত্মা যার উপর ভর করে ধীরে ধীরে তাকেও আত্মার দিকে টেনে নেয়। আর আপনারা তো বুঝতেই পারছেন আমি আত্মার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াই। তাই আত্মা চেয়েছিল কাল রাতের মধ্যে কাজ শেষ করে এখান থেকে চলে যেতে। সেটা আমি বুঝতে পেরে, আমি চিতার ছাই মেসানো জল সনাতন আর আত্মা চারদিকে ছড়িয়ে দিতেই, আত্মা ছটফট করতে থাকে। সনাতনের গলায় তখন যে চিৎকারের আওয়াজ আপনারা শুনেছিলেন সেটা সনাতনের নয়। আত্মার ওর পুরো শরীরটাই প্রায় বশ করে নিয়েছিল। আমি ছাই মেশানো ঘটির জলের মধ্যে, মন্ত্র বলে আত্মাকে, আবদ্ধ করে ফেলি এবং তারপর তাকে পবিত্র জলে মুক্ত করে দেওয়ার জন্যই পুকুরের দিকে যাই। আর এই কাজে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই করতে হতো, না হলে আত্মা আবার বেরিয়ে, আগে আমাকে মারবে তারপরে পুরনো দেহের দিকে ফিরে যাবে এবং তাকেও মেরে ফেলবে। কিন্তু আমি আমার কাজে সফল হয়েছি, আর সেটা আপনারা সবাই দেখতে পেরেছেন। যারা আমার সাথে পুকুরে গিয়েছিল তারা সবাই নিজের চোখে দেখে আমি পুকুরের জলে ঘটির কাপড় খুলে জলে ভাসিয়ে দিতেই পুকুরের পাশে একটা বড় গাছের ডাল হঠাৎ ভেঙে পড়ে আর এটাই সংকেত আত্মা ফিরে গেছে তার লোকে।
এরপর প্রায় ২-৩ দিন বিশ্বরা ওখানে ছিল তারপর কলকাতায় ফিরে আসে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর আপনাদের কাছে এই গল্প বলছি। এখন বিশ্বর সনাদা সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছে। আর কোন সমস্যাই হয়নি কোনদিন ওই ঘটনার পর। এবার আপনারাই বিচার করে বলুন এই ঘটনার সত্যতা।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Debanshu Ghosh |
Intro & Ending | Olivia Das |
Kathak | Sourodeep Roy |
Characters | Name |
---|---|
Kali Prosonno Banerjee | Debanshu Ghosh |
Sona Da | Joydeep Lahiri |
Find us on Facebook – click here