বাঙালীর ফুটবল
Views: 0
বাঙালীর ফুটবল:
শ্রীরামপুরের ধূসর আকাশের নীচে, হুগলী নদীর তীরে, একটি ছোট্ট বাড়িতে জন্ম নিয়েছিল বিট্টু। তার জন্মের দিন থেকেই, যেন বাতাসে ছড়িয়ে ছিল একটা অজানা সম্ভাবনার গন্ধ। বিট্টুর বাবা অনিমেষবাবু, একজন সামান্য সরকারি কর্মচারী, আর মা সুপ্রিয়া, গৃহিণী। দুজনেই স্বপ্ন দেখতেন তাদের ছেলে একদিন বড় হয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বিট্টুর জীবনে এল একটা অপ্রত্যাশিত মোড়। মাত্র চার বছর বয়সে, পাড়ার এক দাদার কাছ থেকে পেয়ে গেল একটা পুরনো ফুটবল। সেই মুহূর্ত থেকেই যেন বদলে গেল তার জীবনের গতিপথ। স্কুলের পড়া থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সবকিছুর চেয়ে বড় হয়ে উঠল সেই চামড়ার গোল বস্তুটা।
বিট্টুর ছোটবেলার দিনগুলো কেটেছে শ্রীরামপুরের ধুলোমাখা গলিতে। সকাল হতে না হতেই ছুটে যেত পাড়ার মাঠে। স্কুলের পর আবার সেই একই ছবি। বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত ফুটবল খেলতে খেলতে। মা-বাবার ডাক শুনতেই পেত না। অনেক সময় অন্ধকার নেমে এলে তবেই ফিরত বাড়ি।
একদিন স্কুলের টিফিনের সময় বিট্টু দেখল টিভিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যাচ। সেখানেই প্রথম দেখা ওয়েন রুনির সাথে। রুনির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। সেই মুহূর্ত থেকেই রুনি হয়ে উঠলেন তার আদর্শ।
“একদিন আমিও ওয়েন রুনির মতো খেলব,” – বিট্টু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল অনেক কঠোর। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বিট্টু। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। তারা চাইতেন বিট্টু পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হোক, ভাল চাকরি করুক।
“ফুটবল খেলে কি হবে? ওতে কি পেট চলে?” – প্রায়ই এমন কথা শুনতে হত বিট্টুকে।
কিন্তু সে ছাড়বার পাত্র ছিল না। যখনই সুযোগ পেত, ছুটে যেত মাঠে। ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে স্কুল ফুটবল টিমে জায়গা করে নিল। প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে লাগল। ধীরে ধীরে নাম ছড়াতে লাগল তার।
এভাবেই কেটে গেল বিট্টুর কৈশোর। ফুটবল আর পড়াশোনার মাঝে দোলাচলে। একদিকে ছিল তার স্বপ্নের টান, অন্যদিকে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা। দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে অনেক সময় হাঁসফাঁস করে উঠত বিট্টু। কিন্তু তবুও সে হাল ছাড়েনি।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিট্টুর জীবনে এল নতুন মোড়। কলকাতার একটি কলেজে ভর্তি হল সে। নতুন শহর, নতুন পরিবেশ। কিন্তু মনের মধ্যে সেই পুরনো স্বপ্ন – একদিন ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে খেলা।
কলেজে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই বিট্টু যোগ দিল কলেজের ফুটবল টিমে। সেখানে তার প্রতিভা আরও প্রস্ফুটিত হতে লাগল। কলেজের কোচ রমেশ স্যার বিট্টুর মধ্যে দেখতে পেলেন অসাধারণ সম্ভাবনা।
একদিন প্র্যাকটিসের পর রমেশ স্যার বিট্টুকে ডেকে বললেন, “তোমার মধ্যে অসাধারণ প্রতিভা আছে। যদি পরিশ্রম করতে পার, একদিন বড় খেলোয়াড় হতে পারবে।”
বিট্টুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। “সত্যি স্যার? আপনি কি মনে করেন আমি জাতীয় দলে খেলতে পারব?”
রমেশ স্যার হেসে বললেন-“কেন নয়? তবে তার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে। রোজ সকালে উঠে প্র্যাকটিস করতে হবে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম – সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার।”
সেদিন থেকে বিট্টুর জীবনে শুরু হল নতুন অধ্যায়। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ছুটত মাঠে। দুঘণ্টা কড়া প্র্যাকটিসের পর ফিরে আসত হস্টেলে। তারপর কলেজ, আবার বিকেলে প্র্যাকটিস। রাতে পড়াশোনা।
কিন্তু এই কঠোর রুটিন মেনে চলা সহজ ছিল না। অনেক সময় ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইত বিট্টু। কিন্তু তখনই মনে পড়ত ওয়েন রুনির কথা। কীভাবে তিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেই প্রেরণায় আবার উদ্যম ফিরে পেত বিট্টু।
ধীরে ধীরে ফল ফলতে শুরু করল। কলেজের ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হল বিট্টুর দল। সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেল বিট্টু। খবরের কাগজে ছাপা হল তার ছবি।
কিন্তু এই সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে এল নতুন সমস্যা। পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে লাগল বিট্টু। প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারল না। খবর পেয়ে ছুটে এলেন বাবা-মা।
“এভাবে চললে কী হবে?” – অনিমেষবাবু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। “ফুটবল নিয়ে মেতে থাকলে পড়াশোনা কীভাবে হবে? ভবিষ্যৎ কী হবে তোমার?”
বিট্টু চুপ করে রইল। কী বলবে সে? কীভাবে বোঝাবে যে ফুটবল তার কাছে শুধু খেলা নয়, জীবন?
সুপ্রিয়া ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আমরা তোর ভালোর জন্যই বলছি রে। একটু ভেবে দেখ।”
সেদিন রাতে ঘুমাতে পারল না বিট্টু। বারবার ভাবতে লাগল – কোনটা ঠিক? স্বপ্নের পিছনে ছোটা, নাকি বাবা-মার কথা শোনা? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল – দুটোই করবে। পড়াশোনাও করবে, আবার ফুটবলও ছাড়বে না।
পরের দুবছর কেটে গেল অক্লান্ত পরিশ্রমে। সকালে উঠে প্র্যাকটিস, তারপর কলেজ, বিকেলে আবার মাঠে। রাতে পড়াশোনা। শরীর ও মন দুটোকেই চরম পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হল। কিন্তু বিট্টু হাল ছাড়ল না।
গ্র্যাজুয়েশনের শেষ বছরে এল সুখবর। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দলে নির্বাচিত হল বিট্টু। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার ফলও ভাল হল। বাবা-মা দুজনেই খুশি।
কিন্তু তখনও জানত না বিট্টু, জীবন তার জন্য কী পরীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছে।
কলেজ শেষ হওয়ার পর বিট্টুর জীবনে এল নতুন চ্যালেঞ্জ। একদিকে ছিল ফুটবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন, অন্যদিকে ছিল পরিবারের প্রত্যাশা – একটা ভাল চাকরি করা।
রাজ্য দলে খেলার সুযোগ পেয়েছিল বিট্টু, কিন্তু সেখান থেকে জাতীয় দলে ওঠা ছিল আরও কঠিন। প্রতিযোগিতা ছিল তীব্র।
সারা ভারত থেকে হাজার হাজার প্রতিভাবান ফুটবলার জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করছিল।
বিট্টু বুঝতে পারল, শুধু প্রতিভা থাকলেই হবে না, দরকার পরিকাঠামো, সুযোগ, এবং একটু ভাগ্যের। কিন্তু তার কাছে এসবের কোনটাই ছিল না। শ্রীরামপুরের ছেলে হয়ে কলকাতায় পড়াশোনা করা ছাড়া আর কোন বড় সুযোগ সে পায়নি।
একদিন সকালে অনিমেষবাবু বিট্টুকে ডেকে বললেন, “বাবা, তোমার বয়স এখন তেইশ। এবার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। চাকরির চেষ্টা করো।”
বিট্টু চুপ করে রইল। কী বলবে সে? কীভাবে বোঝাবে যে তার স্বপ্ন এখনো মরে নি?
সুপ্রিয়া ছেলের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন- “তুমি যা ভাল বোঝ করো। কিন্তু মনে রেখো, জীবনে শুধু স্বপ্ন নিয়ে চলে না। বাস্তবতাও দেখতে হয়।”
সেদিন রাতেও ঘুমাতে পারল না বিট্টু। বারবার ভাবতে লাগল – কী করা উচিত? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল – আরও একটা বছর চেষ্টা করবে। যদি জাতীয় দলে জায়গা না হয়, তবে চাকরির চেষ্টা করবে।
পরের এক বছর কেটে গেল অক্লান্ত পরিশ্রমে। সকাল থেকে রাত – শুধু প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। মাঝে মাঝে ছোটখাটো টুর্নামেন্টে খেলত। কিন্তু বড় কোন সুযোগ এল না।
একদিন খবরের কাগজে দেখল, ভারতীয় জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় বাছাই হচ্ছে। আশায় বুক বেঁধে গেল ট্রায়ালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হল না।
সেদিন সন্ধ্যায় হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরল বিট্টু। বাবা-মা দুজনেই চুপচাপ। কেউ কিছু বলল না। কিন্তু বিট্টু বুঝতে পারল, এবার তাকে নতুন পথ বেছে নিতে হবে।
পরের সপ্তাহ থেকে শুরু হল চাকরির খোঁজ। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন – সবার কাছে খবর দিল। অনেক জায়গায় আবেদন করল। কিন্তু কোথাও সুযোগ এল না।
মাস ছয়েক পর একদিন খবর এল – কলকাতার একটা ব্যাংকে চাকরির সুযোগ আছে। বিট্টু ইন্টারভিউ দিল। দুসপ্তাহ পর জানা গেল – চাকরি পেয়েছে সে।
বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে গেল। অনিমেষবাবু-সুপ্রিয়া দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু বিট্টুর মনের ভেতর একটা অজানা বেদনা জন্ম হতে লাগল।
ব্যাংকের চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে এল বিট্টু। নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ। সকাল নটা থেকে বিকেল পাঁচটা – অফিস। তারপর বাড়ি ফিরে বিশ্রাম। এভাবেই কেটে যেতে লাগল দিন।
কিন্তু মনের ভেতর সেই পুরনো আগুন নেভেনি। প্রতি শনিবার-রবিবার ছুটে যেত মাঠে। বন্ধুদের নিয়ে খেলত। মাঝে মাঝে লোকাল টুর্নামেন্টে অংশ নিত।
এভাবে কেটে গেল পাঁচ বছর। একদিন অফিসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল বিট্টু। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা বিজ্ঞাপন – “যুব ফুটবল কোচের প্রয়োজন।” বিজ্ঞাপনটা পড়ে মনটা নেচে উঠল বিট্টুর।
সেদিন রাতে বারবার ভাবতে লাগল – কী করা উচিত? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল – আবেদন করবে।
পরের সপ্তাহে ইন্টারভিউ দিল বিট্টু। দুসপ্তাহ পর জানা গেল – নির্বাচিত হয়েছে সে। কিন্তু এবার সমস্যা হল অন্য জায়গায়। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?
বাবা-মাকে ফোন করে সব খুলে বলল বিট্টু। প্রথমে তাঁরা রাজি হলেন না। কিন্তু ছেলের আগ্রহ দেখে শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিলেন।
“তোর ভাল লাগে যা, তাই কর,” – সুপ্রিয়া বললেন। “আমরা তোর পাশে আছি।”
এভাবেই শুরু হল বিট্টুর নতুন জীবন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ফুটবল শেখানো। তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া নিজের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন।
বছরের পর বছর কেটে গেল। বিট্টু এখন ত্রিশের কোঠায়। তার কোচিং সেন্টার থেকে অনেক ভাল খেলোয়াড় বেরিয়েছে। কেউ কেউ রাজ্য দলেও খেলছে।
একদিন সকালে প্র্যাকটিস করাচ্ছিল বিট্টু। হঠাৎ একটা ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আপনি কি কখনও ভারতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন?”
বিট্টু একটু থমকে গেল। তারপর হেসে বলল, “হ্যাঁ, দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা পূরণ হয়নি।”
ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কি আপনি দুঃখিত?”
বিট্টু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “না রে, দুঃখিত নই। কারণ আমি এখন তোদের মধ্যে দিয়ে সেই স্বপ্ন দেখছি। তোরা যখন ভারতের হয়ে খেলবি, তখন মনে হবে আমিও খেলছি।”
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বিট্টু ভাবল – জীবনটা কী অদ্ভুত! যে স্বপ্ন নিজে পূরণ করতে পারেনি, সেই স্বপ্নই এখন হাজার হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে সে।
বছরের পর বছর গড়িয়ে গেছে। বিট্টু এখন ষাটের কোঠায়। চুল সম্পূর্ণ সাদা, মুখে ভাঁজ পড়েছে। কিন্তু চোখে এখনও সেই তারুণ্যের দীপ্তি।
আজ বিট্টুর কোচিং সেন্টারের কুড়ি বছর পূর্তি। কিন্তু এবার অনুষ্ঠানটা একটু বড় করে করা হয়েছে। কারণ শুধু সেন্টারের বার্ষিকী নয়, এটা বিট্টুর বিদায় অনুষ্ঠানও বটে।
সকাল থেকেই মাঠ ভরে গেছে মানুষের ঢলে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসেছে তাদের বাবা-মা’দের নিয়ে। পুরনো ছাত্ররা এসেছে তাদের পরিবার নিয়ে। এমনকি অনেক বিখ্যাত ফুটবলারও এসেছেন – যারা একসময় বিট্টুর ছাত্র ছিলেন।
বিকেলে শুরু হল অনুষ্ঠান। প্রথমে বিট্টুর বক্তৃতা। সে বলল, “কুড়ি বছর আগে যখন এই সেন্টার শুরু করেছিলাম, তখন জানতাম না এটা এতদূর যাবে। আমি শুধু চেয়েছিলাম আমার অপূর্ণ স্বপ্নটাকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু আজ দেখছি, সেই স্বপ্ন কত বড় হয়ে গেছে।”
তারপর একে একে বক্তৃতা দিলেন বিট্টুর ছাত্ররা। কেউ এখন জাতীয় দলের অধিনায়ক, কেউ বিদেশি ক্লাবে খেলছেন, কেউ বা কোচ হয়েছেন। সবার কথায় একটাই সুর – বিট্টু তাদের শুধু ফুটবল শেখাননি, জীবন জিততে শিখিয়েছেন।
সবশেষে উঠলেন অতনু – বিট্টুর প্রথম দিকের ছাত্র, যিনি এখন ভারতীয় ফুটবল দলের প্রধান কোচ।
তিনি বললেন, “বিট্টু স্যার আমাদের যে শুধু স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, তাই নয়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেও শিখিয়েছেন। আজ যদি ভারতীয় ফুটবল বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে, তার পেছনে বিট্টু স্যারের অবদান অনস্বীকার্য।”
অতনুর কথা শুনে বিট্টুর চোখ ছলছল করে উঠল। মনে পড়ল সেই দিনের কথা, যখন সে নিজেই স্বপ্ন দেখত জাতীয় দলে খেলার। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি বটে, কিন্তু তার থেকেও বড় কিছু হয়েছে। সে জাগিয়েছে হাজার হাজার স্বপ্ন, গড়ে তুলেছে একটা প্রজন্ম।
অনুষ্ঠানের শেষে যখন সবাই বিদায় নিচ্ছিল, একটি ছোট্ট মেয়ে এসে বিট্টুকে জড়িয়ে ধরল। “দাদু, আপনি চলে যাচ্ছেন? আর কে আমাদের ফুটবল শেখাবে?”
বিট্টু মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলল, “আমি কোথাও যাচ্ছি না মা। আমি থাকব তোমাদের হৃদয়ে, তোমাদের খেলায়। আর তোমাদের শেখাবে আমার ছাত্ররা, যারা এখন তোমাদের কোচ।”
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে বিট্টু আবার সেই পুরনো ফটো আলবামটা খুলল। প্রথম পাতায় ওয়েন রুনির ছবি। পাশেই বিট্টুর নিজের ছবি – কলেজের ফুটবল টিমের জার্সি পরা। তারপর আরও অনেক ছবি – তার ছাত্রদের, তাদের সাফল্যের। শেষ পাতায় আজকের অনুষ্ঠানের ছবি – তিন প্রজন্মের ফুটবলার একসাথে।
হঠাৎ বিট্টুর মনে হল, এই তো জীবন। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলা স্বপ্নের ধারা। সে হয়তো নিজে জাতীয় দলে খেলতে পারেনি। কিন্তু তার স্বপ্ন থেকেই জন্ম নিয়েছে আজকের ভারতীয় ফুটবল।
সেই রাতে বিট্টু আবার স্বপ্ন দেখল। দেখল, সে আবার সেই কিশোর বিট্টু। মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বল। আর দূরে গোলপোস্ট। কিন্তু এবার সে একা নয়। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার ছাত্ররা, তাদের সন্তানেরা, এমনকি তাদের সন্তানদের সন্তানেরাও। সবার চোখে একই স্বপ্ন – ভারতীয় ফুটবলকে বিশ্বের শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।
বিট্টু বুঝল, এটাই তার জীবনের সার্থকতা। সে শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, সে একটা যুগের প্রবর্তক। ৭তার স্বপ্ন থেকে জন্ম নিয়েছে একটা নতুন ভারত, যেখানে ফুটবল শুধু খেলা নয়, জীবনের প্রতিচ্ছবি।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিট্টু বেরিয়ে পড়ল মাঠের দিকে। আজ আর সে কোচ নয়। কিন্তু তবুও মাঠে যাওয়া ছাড়তে পারবে না। কারণ মাঠেই তো তার জীবন, তার স্বপ্ন, তার সব কিছু।
মাঠে পৌঁছে দেখল, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো হবে ভবিষ্যতের মেসি, রোনাল্ডো বা নেইমার।
বিট্টু মনে মনে বলল, “খেলো, খেলতে থাকো। তোমাদের মধ্যেই বেঁচে থাকবে আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা।”
এভাবেই শেষ হল বিট্টুর গল্প। কিন্তু এটা শুধু বিট্টুর গল্প নয়। এটা সেই সব মানুষের গল্প, যারা নিজের স্বপ্ন পূরণ না হলেও হাজার হাজার স্বপ্ন বুনে যায়। যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বিট্টুর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি – স্বপ্ন দেখতে, সেই স্বপ্নের জন্য লড়াই করতে, আর হেরে গেলেও হাল না ছাড়তে। কারণ জীবন শুধু জেতা-হারা নয়, জীবন হল অবিরাম চলার নাম। আর সেই চলার পথেই আমরা খুঁজে পাই আমাদের প্রকৃত জয়।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Soumen Sadhukhan |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Sourodip Roy |
Characters | Name |
---|---|
Bittu | Joydeep Lahiri |
Baba | Debanshu Ghosh |
Ma | Olivia Das |
Others | Joydeep Lahiri, Sumona Das, Ayush Mosel, Olivia Das, Debanshu Ghosh |
Find us on Facebook – click here