এ তিথি শুধু তোমাকে পাওয়ার
Views: 1
এ তিথি শুধু তোমাকে পাওয়ার:
তাপসকে সবাই কলেজের হিরো বলে। গান নিয়ে, লেখা-পড়া নিয়ে এমন দ্বিতীয় কেউ নেই যে কথা বলে। শান্তিনিকেতনে এম.এ পড়ছে। ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে কিছুদিন হলো, রেজাল্ট বেরোতে এখনো মাসখানেক বাকি আছে । প্রতি বছরের মতো এ বছরও গানের প্রতিযোগিতা হবে। সেই পাঁচ বছর আগে বি.এ. ফার্স্ট ইয়ার থেকে শুরু হয়েছিল। বি.এ. – এর সব বিভাগের ছাত্রছাত্রী ; আবার এম. এ. – এর সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা সবাই অংশ নে নেয়। ছেলেরা আলাদা হয়ে; একটা দল হয়। আর মেয়েরা আলাদা হয়ে; একটা দল হয়। প্রোফেসররা বিচারক হন অথবা বাইরে থেকে কোনো বড়ো শিল্পী বা ওস্তাদ ব্যক্তি আসেন। এই এত বড়ো প্রতিযোগিতায় বরাবর ছেলেদের দলই জিতে এসেছে। কারণ এই দলে তাপস আছে।
তাছাড়া বি. এ. ফার্স্ট ইয়ার থেকে এম. এ.-র এই দুই বছর; অবশ্য লাস্ট ইয়ারের রেজাল্ট এখনো বেরোয়নি, তবুও সবাই জানে তাপসই রেকর্ড মার্কসের নম্বর পেয়ে এসেছে। তাই প্রিন্সিপাল , অন্যান্য প্রোফেসরগণ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের মতানুসারে তাপসকেই এই কলেজের নতুন ইংলিশ প্রোফেসর নিয়োগ করা হবে। প্রথমে অস্থায়ী হিসাবে, তারপর ছয় মাস পর স্থায়ী।
যাক, এবার দেখি অন্য দিকে। আমাদের গল্পের একজন হিরোইনও তো চাই। বীরভূম গ্রামের একটি মেয়ে। দেখতে অতীব সুন্দরী, মানে খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম পিউ মিত্র। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়াতে পিউর মা পিউকে নিয়ে ওর মামারবাড়িতে এসে ওঠে। মামা বিজয় মজুমদার ছিলেন স্কুল মাস্টার; খুবই রাসভারী মানুষ। একটু কিপটেও বটে। মামার সংসারে, স্ত্রী আশাদেবী, মেয়ে শ্যামলী ও ছেলে অলক। পিউরা যখন মামারবাড়ি আসে, তখন দাদুও বেঁচে ছিল। শ্যামলী পিউয়ের থেকে ৩ বছরের বড় আর অলক পিউয়ের বয়সী। মামা যে বোন ও ভাগ্নির আসতে খুব একটা খুশি হয়েছিল; সেরকমটা একেবারেই নয়। কিন্তু আইনের ব্যাপার, বাবা জীবিত তখনও; কাজেই মুখ বন্ধ রাখাই ভালো। তবে একটা সুবিধা বোন আসাতে, বাড়ির কাজের লোক রাখতে হয় না। তবে তার বদলে দুটো মানুষ বাড়তি।
ভাগ্নির পড়াশোনা আর বোনের রান্নার সুখ্যাতি করতেই হয়। মামা ও মামী দুজনেই খুব খুশি বোনের হাতের রান্না খেয়ে ও ভাগ্নির গানের গলা শুনে। এখন আবার সংসারে সাহায্যও করছে, ভাগ্নির গানের টিউশানি, ও পড়ার টিউশানি করে। মামী যদিও গদো গদো হয়ে সুখ্যাতি করে কিন্তু মামার মুখ দেখে বোঝা যায়না। ভালোও বলে না খারাপও বলে না। যাক তবু তো মাথার ওপর একজন গার্জেন আছে। এই ভাল ওদের।
অনেক বলে কওয়ে মামাকে রাজি করিয়ে পিউ এম. এ. তে ভর্তি হয়েছে। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল ভর্তি হওয়াতে। ভর্তির প্রায় চার মাস ওভার হয়ে যাওয়ার পর এর হাতে পায়ে ধরে , ওর হাতে পায়ে ধরে, শেষে পরীক্ষা দিয়ে তবে পাঁচমাস পরে শান্তি নিকেতনে এম. এ. তে ভর্তি হয়েছিল। কলেজে ভর্তি হয়েই শোনে গানের প্রতিযোগিতায় নাম দিতে হবে। এটা নাকি বাদ্ধতামূলক। নাহলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না। সে আবার কি? যে গান জানে না? তাকেও নাম দিতে হবে , কারণ দল ভারী করার জন্য। আজ পাঁচ বছর ধরে মেয়েরা হেরে যাচ্ছে। যে জিততে পারবে, তার জন্য লোভনীয় অফার। যে পন্ডিতজী বা ওস্তাদ আসবেন; তাঁর কাছে বিনা পারিশ্রমিকে দুই বছরের জন্য শিক্ষাগ্রহণ আর ৫০ হাজার টাকার চেক পুরস্কার। হঠাৎ পিউয়ের কাছে অফারটা মন্দ লাগল না। এদিকে বাড়িতে শ্যামলীদির বিয়ে হচ্ছে না টাকার জন্য। অবশ্য মামা এ কথা ফলাও করে বলে। আর পিউর গানে কোনো বড় ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়ার শখও আছে। ব্যাস দুইয়ে দুইয়ে চার। পিউ প্রতিযোগিতাতে নাম দিয়েই দিলো। যা হয় হবে। দেখাই যাক না, যে ছেলেটা পাঁচ বছর ধরে জিতে আসছে, তাকে হারাতে পারে কিনা ? একটু যে ভয় লাগছে না তাও নয়। কি জানি, তাকে শিব ঠাকুর জেতাতে পারেন কিনা। পিউ খুব শিব ঠাকুরের ভক্ত।
ক্রমশ এগিয়ে আসছে দিন। ১ মাস হয়ে গেল। আর দিন ১৫ বাকি। কিন্তু পিউয়ের গানের কথা বা গানের গলা সম্বন্ধে ক্রমশ গোটা কলেজ চত্বরে কানা ঘুসো সোনা যাচ্ছে। ” বাহ্ মেয়েটা অদ্ভুত গায় তো?”, ” ভারী সুন্দর গলা তো,” “এমন গান এ কলেজে আগে কেউ গেয়েছে কিনা জানা নেই। ” এমন সময় সব কথা রটেছে। এভাবে একদিন তাপসও শোনে, ওর প্রিয় বন্ধু তুহিনকে জিজ্ঞাসা করে,
-” কে মেয়েটা কে? ওকে চিনি না। দেখিনি? এই পাঁচ বছরে তো প্রায় সব মেয়েকেই দেখেছি। যেচে এসে গায়ে পরে আলাপ করে গেছে। এ কে?”
তুহিন বললো,
-” আরে এইই পিউ। মানে মেয়েটার নাম। “
একটু হেসে তুহিন বলল,
-” একটু আলাদা। আর পাঁচটা মেয়ের মতন নয়। এই মাস দুয়েক আগে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছে। এম. এ.ফার্স্ট ইয়ারে। “
তাপস বলে,
-” গান নাকি খুব সুন্দর গায়। গলায় নাকি খুব টেকনিক আছে?”
তুহিন বললো,
-“বলে সবাই। এমন কি স্যার ম্যাডামরাও বলে। আমি আর কি বুঝি বল। আরে বাদ দে তো। আসল জায়গায় দেখা যাবে। “
ক্রমশ এগিয়ে এলো আসল দিন। দুদিন ধরে প্রতিযোগিতা হলো । ১ দিন হলো সিলেকশন রাউন্ড। পরদিন হলো ফাইনাল। সিলেকশন রাউন্ডে ছিলেন প্রফেশররা এবং একজন বিশিষ্ট ও বিখ্যাত শিল্পী কোকিল কন্ঠী মালা মুখার্জী। সেখানে হলো গানের শেষ অক্ষর ধরে দুলিনে করে গাওয়া গান। আর কে কত রকমের ঠিক সুরে, তালে, লয়ে, ভাষার গান জানে। আর ২ দিনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওস্তাদ এসেছিলেন। বাজনার সুরে গান গাইতে হবে। আবার যে তাল লয়ে বলবেন, সেই অনুযায়ী গাইতে হবে।
বলা বাহুল্য দুদিনই জিতে গেলো, কে বলুনতো? না না পাঁচ বছর ধরে যে জিতে এসেছিলো সেই তাপস চৌধুরী নয়, জিতে গেলো পিউ মিত্র। মেয়েদের উল্লাস যেন বাঁধ ভাঙা নদীর স্রোতের মতন। যে সব মেয়েদের, গানের জন্য তাপসের ওপর রাগ ছিল। সবাই “অহংকারী”, “দেমাকি” বলে অভিহিত করতো। তারা নিজেদের পয়সায় গিফট কিনে পিউকে সম্মান জানাচ্ছে। পিউয়ের মনে একটাই আশা , একটাই ইচ্ছা তার সাফল্যের তাকে শ্যামলীদের বিয়ে হয়ে যাক।
এবার চলুন, তাপসের বাড়ির কথায় আসি। বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাজীব চৌধুরীর ছোট ছেলে তাপস চৌধুরী। দাদা তন্ময় চৌধুরী ডাক্তার। বৌদি, পৃথা চৌধুরী হাইস্কুলের টিচার। মা প্রতিমা চৌধুরী এককালের বড়ো গায়িকা ছিলেন, এখন বাড়িতেই গানের স্কুল চালান। ছোট বোন ঝর্না, তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। এমন বাড়ির ছেলে তাপস। তার কিনা পাঁচ বছরের রেকর্ড ভাঙলো একটা মধ্যবিত্ত গাঁয়ের মেয়ে। যাকে কেউ জানেনা,কেউ চেনে না। বাড়ির সবাই অবাক। কি বলে তাপসকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছে না। সবাই বলছে,
-“মেয়েটাকে দেখতে হবে, ওর কথা শুনতে হবে, আলাপ করতে হবে।”
দাদা বলছে,
-“হ্যাঁ রে তপু, তুই তো মেয়েটাকে দেখছিস কেমন দেখতে?”
রাগ করে তাপস বলে,
-” জানিনা, যেদিন প্রাইজ দেবে, সেদিন যেও, দেখো।”
মা হেসে বলেন ,
-” শিল্পীদের রাগ করতে নেই। হতেই পারে। ঠিক আছে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের দিন যাবো। আলাপ করে আসবো।”
বৌদি পৃথা লাফিয়ে ওঠে,
-” সেকি মা ঐদিন যাবেন? তপু তো রেগে ফায়ার। অতো বলেছে, ও আর কলেজমুখো হবে না।”
প্রতিযোগিতার পরের দিন ছুটি থাকার দরুন সবাই সকালে চায়ের আসরে এতো কথা বলছে। তাপস বললো,
-” বেশ তো তোমরা যাও না, আমি না গেলেই হল। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।”
বাবা বললেন,
-“ভেবে বলছো তো?”
-“কেন ভেবে বলার কি আছে?”
চুরুটে টান্ দিয়ে ব্যারিস্টার বাবু বলেন,
-” দুদিন পরে ওই কলেজের প্রোফেসার হবে, ওই মেয়েটা তোমার ছাত্রী হবে। তখন?”
কথাটা শুনে সবাই চুপ করে মাথা নাড়ে। মা বলেন,
-” রাগ করো না তপু। এতদিন তুমি জিতে এসেছো বলে কি আর কেউ জিততে পারবেনা? ইটা মনে করা অন্যায়। প্রকৃত একজন শিল্পী হলে আর একজন শিল্পীকে সম্মান করা উচিত। এটা তার ধর্ম।”
দুদিন পরে তাপসদের বাড়িতে সবাইকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে কলেজ থেকে চিঠি আসে। তাপসের কেন জানিনা পিউয়ের সাথে কথা বলতে বা আলাপ করতে ইচ্ছাও করছে। বার বার ওর ওই চোখদুটোর কথা মনে পড়ছে।
এদিকে পিউয়ের বাড়িতেও সবাইকে চিঠি দিয়ে কলেজ থেকে নিমন্ত্রণ করেছে। চিঠি দেখে তো মামা খুব খুশি; কারণ ভাগ্নি জিতেছে বলে কথা। কিন্তু প্রতিযোগিতায় যাবার দিন বাধা দিয়েছে এই বলে,
-” হেরে গেলে, আর কলেজমুখো হতে দেব না। এই বলে দিলাম।”
আর আজকে মামা নিজেই বলছে,
-” ওরে শ্যামলী কাল পিউ যখন ফাংশানে যাবে, তখন তোর একটা ভালো শাড়ী পরিয়ে দিস। ওর তো একটা ভালো শাড়ীও নেই।”
-” না না মামা তুমি ব্যস্ত হয়েও না। মায়ের অনেক ভালো শাড়ী আছে। আমি ওই থেকেই একটা পড়বো। ” – বললো পিউ।
পিউ মামীমার কাছে এসে আস্তে আস্তে বললো,
-“মামীমা মামাকে বলো, শ্যামলীদির দুদিন আগে যে সম্বন্ধটা এসেছিলো, কিন্তু মামা টাকার জন্য কথা বলতে পারলো না। তাদের সাথে আবার কথা বলতে বলো। অত ভালো ছেলে।”
মামীমা পিউর মাথায় হাত রেখে বললেন,
-“তোর ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না মা। হ্যাঁ রে তোর মায়ের অনুমতি নিয়েছিস? তোরও তো ভবিষ্যৎ আছে।”
পিউয়ের মা সন্ধ্যা দেবী পিছনেই এসে পড়েছিলেন, কথাটা শুনে বললেন,
-” কি যে বলো বৌদি।আগে তো শ্যামলী। পিউয়ের এখনো অনেক দিন পরে আছে। ও ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি পিউকে নিয়ে চিন্তা করো না।”
ফাংশানের দিন। স্টেজে তখন সবে বক্তৃতা আরম্ভ হয়েছে। এখনও একে একে অনেকজন বক্তৃতা দেবেন। পিউ স্ক্রিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ীতে যেন দেবী লাগছে, গায়ে লাল ব্লাউস। মাথার চুল এলো করা। কালো ভ্রমরের মতন গোছা চুল একদম কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে দু – চারটে চুল উড়ে কপালে মুখে পড়ছে, হাতটা ব্যস্ত সেগুলো সরাতেই….. হটাৎ চোখ পরে হাত চারেক দূরে তাপস দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পিউ কি ভেবে আস্তে আস্তে ওর দিকে এগোলো
কাছে এসে বলল,
-“সরি।”
-” কেন? সরি কেন?”- তাপস বলে। সারা শরীরে যেন একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়।
-” জানি আপনি আমার ওপর রেগে আছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন……..”
একটু মিষ্টি হেসে তাপস বললো,
-“কে বলেছে আপনার ওপর আমি রেগে আছি। “
একটু থেমে বলে,
-” আমার খুব আনন্দ হয়েছে। আজ জানলাম কেউ আছে যে, আমায় হারাতে পারে। এরপর হয়তো গান গাওয়ার আর সময় পাবো না। “
-” কেন? এত্ত সুন্দর গান গান ………”
পিউয়ের কথা শেষ হবার আগেই তুহিন এসে উপস্থিত হয়। পিউকে দেখে বলে,
-” আরিব্বাস। অষ্টম আশ্চর্য এখানে?”
তাপস বললো ,
-“সে আবার কি?”
তুহিন তাপসের কথার উত্তর না দিয়ে পিউকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“তোমার সাথে আলাপ হয়নি। আমি তুহিন দাস। আমারও এবছর কলেজে শেষ তাপসের মতন। তবে তাপসের পড়াশোনা শেষ। এবার এই কলেজেই প্রফেসারি করবে। আর আমি ব্যাক টু বাড়ি।” কথাটা বলেই তুহিন হাসে।
পিউ বলে,
-“ও আচ্ছা। তবে কি বললেন তখন কি অষ্টম আশ্চর্য না কি! সেটার মানে বুঝলাম না। “
-” অরে ওটা আমার কথা নয়, ওটা কলেজের সবার কথা।” হাসতে হাসতে বলে তুহিন।
তাপস বলে,
-” হ্যাঁ বুঝলাম। কিন্তু তুই ওনাকে ঐ সম্বোধনটা করলি কেন?”
অবাক হয়ে যায় তুহিন। বলে,
-” আরে ঐ তুই পিউকে আপনি বলছিস কেন? দুদিন পরে ওই তোর ছাত্রী হবে। পিউও ইংলিশ নিয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয় ও দারুন লেখাপড়ায়। সিজিনের মাঝখানে পরীক্ষা দিয়ে ভালোভাবে পাশ করে এখানে ঢুকেছে। ঐ জন্যই ওকে সবাই অষ্টম আশ্চর্য বলে। “
লজ্জা পায় পিউ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এতো সুন্দর ওকে লাগছে। কি বলবো। তুহিন আড়চোখে তাপসকে দেখে। তাপস মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পিউর দিকে তাকিয়ে আছে। গলা খাকরানি দিয়ে তুহিন বলে,
-“চল তাপস ঐদিকে যাই। বক্তৃতা শেষ হয়ে আসছে।”
স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে তাপস বলে,
-” একটা অনুরোধ করবো?”
মাথা নেড়ে পিউ বলে,
-“বলুন। “
-” আজকে পুরষ্কার নেবার পরে বা আগে একটা গান শুনতে চাই।”
কথাটা শুনে হাসে পিউ। চলে যায় তাপস।
বক্তৃতা শেষ হবার পর পুরস্কারের পালা। ৫০ হাজার টাকা প্রদানের পর ঘোষণা হলো; ৫ বছরের মধ্যে একবছর ওস্তাদের কাছে আর ১ বছর বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী মালা মুখার্জীর কাছে শিক্ষানবিশ হিসাবে গান শিখতে পারবে। শেষে সবার অনুরোধে পিউকে দুটি গান গাইতে বলা হলো। একটু চুপ করে থেকে মাইক নিয়ে পিউ বলল,
-” আমি নিশ্চই গান শোনাবো। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে। এতো দিন যার গান শুনে এলেন, তাকে একটি গান গাইতে ডাকা হোক।” সবাই সমস্সরে বলে উঠলো,
-” হ্যাঁ হ্যাঁ তাপসদা কে একটি গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। আসুন।”
তাপস স্টেজে উঠে মাইকের সামনে এসে বললো,
-” না আমি একা গান গাইবো না, আমার সাথে পিউকেও গাইতে হবে। “
বলেই তাপস গান ধরে,
-” সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ……”
প্রথম গানটা শুনে পিউয়ের মনটাও দুলে ওঠে। সেও তাপসের সাথে গলা মেলায়। ওদের দুজনের গান হয়ে যেতে তাপস চলে যায়। তখন পিউ নিজে একা গান ধরে,
-” দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার
গানের ওপারে।
আমার সুরগুলি পে চরণ —
আমি পাই নে তোমারে —“
রাত্রে বাড়ি এসে পিউয়ের মামা বিজয়বাবু বললেন,
-” আমি খুশি হয়েছি। ওই ছেলেটির পাঁচ বছরের রেকর্ড ব্রেক করার জন্য। কিন্তু ওর সাথে গান গাওয়াতে আমি খুশি হয়নি। আর যেন না দেখি কোনোদিন তোমাদের। “
একটু চুপ করে থেকে বিজয় বাবু বললেন,
-” টাকাটা কি তোমার একাউন্ট- এ পড়লো?”
পিউ মামাকে ভয় পায়। বললো,
-” হ্যাঁ কর্তৃপক্ষ আমার নামে নতুন একাউন্ট খুলে তবেই …..”
-” আগে তোমার নামে একাউন্ট ছিল না বলছো?” গম্ভীর মুখে বলে বিজয়বাবু।
মেয়ে শ্যামলী বললো,
-“কেন তুমি জানো
না? ও যা টিউশনি করে আনে তা মায়ের হাতেই তুলে দেয়। কিছু দরকার আবার মায়ের কাছ থেকেই নেয়।”
আস্তে আস্তে পিউয়ের মা সন্ধ্যা দেবী বলেন,
-“কেন দাদা কোনো অসুবিধা আছে?”
-‘ সে তোমরা মা মেয়ে যেন। ” – একটু যেন শ্লেষ মিশিয়ে বললেন বিজয়বাবু।হটাৎ রান্নাঘর থেকে মামিমা আশা দেবী বলেন,
-” ওই টাকা নিয়ে এতো কথা কেন হচ্ছে জানতে পারি আমি? ওর নিজের একটা ভবিষ্যত নেই” – একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন।
পিউ তাড়াতড়ি বললো,
-” না মামাবাবু তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি যা বলেছি, তুমি তাই ব্যবস্থাই করো।”
মামিমার কাছে এসে পিউ বললো,
-“মামিমা , শ্যামলী দিদির যে সম্বন্ধটা বিষ হাজার টাকার জন্য ভেঙে যেতে বসেছে ; সেটার বিষয়ে কথা মেটাও। টাকার জন্য কিছু অসুবিধা হবে না। আমি কালকেই টাকাটা মামাবাবুর একাউন্ট – এ ট্রান্সফার করে দেব। “
-“কিন্তু পিউ তুই……..”
মামিমার কথা শেষ হতে না দিয়েই পিউয়ের মা সন্ধ্যা দেবী বলেন,
-” কি যে বোলো বৌদি, শ্যামলী কি আমার মেয়ে নয় ! আর কিছু বোলো না তুমি। তোমরা আশীর্বাদ করো যেন, আমার মেয়ে দশজনের একজন হয়ে ওঠে।” কথাটা বলেই সন্ধ্যাদেবী চোখের জল চেপে পিউয়ের হাত ধরে ঘরে চলে যান।
এদিকে হয়েছে কি তাপস তার বাড়িতে এসে মহা ফাঁপরে পড়েছে। বাবা মা ছাড়া সবাই ওর পিছনে পড়েছে। তুহিন, দাদা, বৌদি, বোন। বাবা রাজীব বাবু এবং মা প্রতিমা দেবী শুধু মুচকি মুচকি হাসছেন। এরপর বাবা রাজীব বাবু চেম্বারে চলে যান।
বোন ঝর্ণা বলে,
-” হ্যাঁ দেখ দাদা তুই আর ওর সাথে গান পেলি না, একদম দুজনা দুলতে দুলতে গেলি বনে।”
বৌদি পৃথা বলে,
-” আরে বাবা, দুলতে হয় বাড়ি গিয়ে দোলো – আমরাও একটু দেখি।”
দাদা তন্ময়ও সাই দিয়ে বলে,
-” স্মৃতিটা মনে হচ্ছে কংক্রিটের মতো জমে গিয়েছে। “
তাপসের বাড়ির সবাই পিউয়ের সাথে আলাপ করে খুব খুশি। যেমন দেখতে তেমন গানের গলা। মা প্রতিমা দেবীর তো বেশ পছন্দ হয়েছে। ছেলে হেরে গেছে বলে মনে কোনো ক্ষোভ নেই।
যাই হোক এরপর কেটে গেল দু- বছর। কলেজে পিউ আর তাপসের ব্যবহার প্রোফেসর আর ছাত্রীর মতন। কেউ অন্য ব্যতিক্রম দেখেনি। কলেজ প্রোগ্রামে, কখনো দুজনে একসাথে গানও গায়নি। সেটা অবশ্য পিউয়ের জন্যই ।
কেউ ভেবে উঠতে পারে না, ধরেও ধরতে পারে না। এমন কি তাপসের বন্ধু তুহিন এখন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ভালো চাকরি পেয়ে ; তাপসের বোন ঝর্ণার সাথে প্রেম করেও পিউ আর তাপসের প্রেম ধরতে পারেনি। একবার ভাবে ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে। আবার ভাবে না না ওদের মধ্যে তেমন কিছু নেই । কিন্তু হটাৎ একদিন ওদের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে বজ্রপাত ঘটে।
কি হলো তাই বলি, পিউ রেকর্ড মার্ক্স্ পেয়ে এম.এ. তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলো।এমন কি তাপস গত দু বছর আগে যা মার্কস পেয়েছিলো, পিউ তার থেকেও বেশি নম্বর পেয়েছে। ওকেও সবার এই কলেজে পাওয়ারই আশা। কিন্তু পিউ এখন পি.এইচ. ডি. করবে।
পিউয়ের এই সাফল্যে তাপসের বাড়িতে যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। সেই আনন্দের জেরে ব্যারিস্টার রাজীব চৌধুরী নিজের ওজন ভুলে পিউয়ের মামা বিজয়বাবুকে ডেকে পাঠালেন। ব্যারিস্টার চৌধুরী ডেকেছেন; কি না কি ব্যাপার। তাই বিজয়বাবু হন্তদন্ত হয়ে এসেছেন। অতি সম্মানের সঙ্গে রাজীববাবু বিজয়বাবুকে অভ্যর্থনা করলেন। খাতির করে বসালেন। বিজয়বাবু তো অবাক। তার মতন নিম্ন-বিত্ত সমাজের মানুষকে কেন এতো খাতির যত্ন করছেন; সেটা বুঝতে পারছেন না। যাইহোক একথা সেকথা বলার পর রাজীববাবু বললেন,
-” আপনার কাছে একটা আবেদন আছে।”
-” কি ব্যাপার ব্যারিস্টার সাহেব, আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা। আমার মতন ব্যক্তিকে কেও এতো খাতির?”-অবাক হয়ে বললেন বিজয়বাবু।
রাজীববাবু বললেন,
-” আপনার কাছে একটা রত্ন আছে, সেটা আমার চাই।”
কথাটা বুঝতে না পরের বিজয়বাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
রাজীববাবু আবার বললেন,
-” বুঝতে পারলেন না। আপনার ভাগ্নি পিউয়ের কথা বলছি। “
একটু হেসে রাজীববাবু আবার বললেন,
-“আপনার ভাগ্নি পিউকে আমার ছোট ছেলে তাপসের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাই। “
এতক্ষন যে বিজয়বাবু বুঝতে পারেনি তা নয়, তবুও অপেক্ষা করছিলেন। এবার তিনি একটু চুপ করে থেকে,ভীষণ গম্ভীর ভাবে বললেন,
-“নিজের মুখেই তো স্বীকার করলেন পিউ একটি রত্ন।”
এবার একটু থেমে বললেন,
-“কেউ কারুর প্রিয় রত্ন চাইলেই যে দিতে হবে। এই রকম কোনো আইন বোধহয় নেই। আপনার ছেলেকে আমার পছন্দ নয়; ব্যারিস্টার বাবু। আমার ভাগ্নির বিয়ে আমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই হবে।”
উঠে দাঁড়ান বিজয়বাবু। তারপর হাত জোর করে বলেন,
-” আচ্ছা চলি; নমস্কার। “
তারপর হন হন করে বেরিয়ে গেলেন। রাজীববাবু অপমানে যেন পাথর হয়ে যান। তার মতন এত বড়ো ব্যারিস্টারের মুখের ওপর যে কেউ কথা বলতে পারে জানা ছিল না। দরজার পাশে সবাই ছিল। তারাও মুখ চুন করে ঘরে প্রবেশ করে। শুধু তাপস ওপরে চলে যায়। রাজীববাবু ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন।
(Emotional sound start)
পিউ সব জানতো। ফোনে রোজ রাত্রে কথা হয় তাপসের সঙ্গে, কিন্তু বাইরে তারা স্যার আর ছাত্রী। আগের দিনই তাপস বলেছিলো,
-” আমার বাবা তোমার মামাকে ডেকে পাঠাবেন, আমাদের বিয়ের কথা বলার জন্য।”
তখনই পিউ বলেছিলো,
-” আমার মনে হয়না আমাদের বিয়ে এতো সহজে হবে।”
গত বছর পিউয়ের মা মারা যান। তরপর থেকে মামা যে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেছে তাকে। এ সংসার থেকে বেরোবার কোনো উপায় নেই। শ্যামলীদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আর মামার ছেলে অলোক ইঞ্জীনিয়ারিং পড়তে ব্যাঙ্গালোরে চলে যাওয়ার পর, ও বাড়িতে একদম একা। মামিমা আর কি করবেন তার জন্য। তিনিও মামাকে বেশ ভয় পান।
(Emotional sound end) (serious sound start)
বাড়িতে এসে বিজয়বাবু খুব মেজাজ দেখান। পিউকে ডেকে বলেন,
-” ব্যাপার কি? ডুবে ডুবে জল খাচ্চো। আর বাইরে সবার সামনে ভালো সাজছো”
মামিমা ছুটে আসেন,
-“কি হয়েছে টা কি? এতো মেজাজ দেখাচ্ছ কেন? মাথাই বা এতো গরম হলো কিসে?”
প্রশ্ন করতেই আরো জ্বলে ওঠেন বিজয়বাবু; বললেন,
-” তোমার ভাগ্নি বেছে বেছে বড়ো লোকের একটা ছেলেকে ধরেছে। এ বাড়ি ছেড়ে যাবার জন্য। এতটুকু অবস্থায় এসেছিলো। খাইয়ে পড়িয়ে বড়ো করলাম। এত বড়ো অকৃতজ্ঞ, এখন পালাবার চেষ্টা করছে। কোথায় মামা মামীকে দেখবে, সে চিন্তা একবারও করে না। শেষ বয়সটা তাদের কিভাবে চলবে সেটা একবার ভাবে না। শুধু নিজের চিন্তা। এতো বড়ো বেঈমান, স্বার্থপর মেয়ে।”
আর সহ্য হলোনা মামিমা আশাদেবীর। চিৎকার করে ওঠেন,
-” চুপ করো চুপ করো। অনেক বলেছো; আরো বললে মুখ খসে পরে যাবে। ও বেঈমান নয়, তুমি বেঈমান। বড়ো হতেই লেখাপড়া শিখে, কোথায় টিউশনি, কোথায় গান শিখিয়ে তোমার সংসারে সাহায্য করে এসেছে। আর আজ তিন বছর হলো তোমার রিটায়ার করার পর থেকেই সংসার চালাচ্ছে। আলোকের পড়ার খরচ চালাচ্ছে। সংসারে যত অসুখ বিসুখ ওই সামলাচ্ছে। আর কি করবে বলতে পারো?”
একটু থামেন মামিমা। হাঁপাতে থাকেন। পিউ ছুটে আসে।
-” তুমি চুপ করো মামী। তোমার টান টা বাড়ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।” বলে পিউ।
মামিমা থামেন না, আবার বলেন,
-” ওর সবটাকে তো নিয়েছো। ওর ভবিষ্যত নেই। ওর ঘর সংসার করতে ইচ্ছা করে না। “
চিৎকার করে ওঠে পিউ,
-” তুমি থামবে মামি। দোহাই তোমার। চুপ করো তুমি।”
মামিমা বসে পড়েন। পিউ ছুটে যায়, মামার কাছে। মামাকে বলে,
মামা তুমি চুপ করো। তোমার প্রেসার বেড়ে যাবে। বিশ্বাস করো। আমি ওসব কিছুই ভাবিনি। তুমি শান্ত হও।”
দুচোখ ভরে ওঠে জলে পিউর। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মামার পায়ের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-” ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। তার কথা তো মনেই পরে না। তোমাকেই বাবা বলে জেনেছি। বিশ্বস করো। ”
কাঁদতে থাকে পিউ। মামার পা ছুঁয়ে বলে,
-” তোমার পা ছুঁয়ে বলছি। তুমি নিজে থেকে আমার কোনো ব্যবস্থা না করলে, আমি নিজে কোনো কিছু করবো না। এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
বিজয়বাবু পা ছাড়িয়ে হন হন করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন; যেতে যেতে বলে গেলেন,
-” মনে থাকে যেন এই কথাটা। “
মামিমা আর ওই ওইখানে বসেই কাঁদতে থাকে।
এদিকে তাপসদের বাড়িতেও একই অবস্থা। ঘন্টা খানেক পরে তাপস নিচে এসে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের কফি বানিয়ে নিয়ে বাবার চেম্বারে আসে। হাসতে হাসতে বলে,
-“একি সবাই দেখছি শোকে মুহ্যমান! কি হয়েছে?”
বাবার কাছে এসে হেসে বলে,
-” আমার হাতের তৈরী কফি খেলে, নতুন বুদ্ধি আসবে ব্যারিস্টার সাহেব।”
হেসে ফেলেন রাজীব বাবু। মায়ের কাছে এসে সুর করে বলে,
-” মা – ওহ মেরি মা! এক কাপ কফি খাও না।”
প্রতিমা দেবী চোখ মুছে হাসি মুখে কফির কাপ নেন। তাপস বৌদির কাছে গিয়ে চুপিচুপি বলে,
-” এখন আমি বিয়ে করবোই না। যতক্ষণ না একটা ভাইপো বা ভাইঝি হচ্ছে। নিৎ বর হবে কে?”
পৃথা তাপসের একটা কান ধরে বলে,
-” দুস্টু ছেলে। হচ্ছে তোমার। “
বলে কফি নেয়। কারণ তাপস কফি ভালোই বানায়। এদিকে দেখে তুহিন মুখ ভার করে; রাগ রাগ ভাব করে বসে আছে। ওর কাছে গিয়ে তাপস ছড়ার সুরে বলে,
-” চাদ শিখালো হাসতে মেদুর, মধুর কথা বলতে। “
কফির কাপ তুহিনের হাতে তুলে দিয়ে, মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দেয়। তারপর বোন ঝর্ণার কাছে গিয়ে সেই একই ভাবে বললো,
-“ঝর্ণা তাহার সহজ গানে, গান জাগালো আমার প্রাণে।”
হেসে ফেলে ঝর্না। তাপস নিজেও এক কাপ কফি নেয়, মনে তার কষ্ট, চোখ তার ভেজা, মাথায় চিন্তা। তবু মুখে হাসি টেনে এনে বলে,
-” এখনই অত ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। সব ঠিক হবে।
-” না তপু তুই হালকাভাবে নিনস না ব্যাপারটা। এমন অপমান আমাকে এর আগে কেউ করেনি।” -রাজীব বাবু বললেন।
কিছুক্ষন থেমে আবার রাজীব বাবু বললেন,
-“আজ আমি চেম্বার বন্ধ রাখলাম যে আজই সব ব্যবস্থা করবো; কি অভদ্র ওর মামাটা। ভালো কথা মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না।”
প্রতিমা দেবী চিন্তিত ভাবে বললেন,
-” আমরা কি খুব তাড়াতাড়ি এগোচ্ছি? আর একটু সময় নিলে ভালো হতো?”
তুহিন বললো,
-“এতো রাগ হচ্ছে যে কি বলবো। ওই কিপ্টে মামাটা ভাগ্নির পয়সায় বসে খাবে বলেই এই রকম করছে। “
– ছিঃ তুহিন। বাজে কথা বলিস না। তুই একটা কথা বল ; তোকে যদি বলি তোর হার্ট মানে হৃৎপিন্ড কাউকে দান করতে, তুই পারবি?”- বলে তাপস।
তুহিন বলে,
-” বাঃ বাঃ! আমি নিজে মোর, অন্যকে বাঁচিয়ে দেব? কি যে বলিস।”
-” এটাই সেই মানে। উনিই বা নিজের হৃৎপিন্ডকে কেন আমায় দেবেন। এটাই সত্যি। ” – বিজ্ঞের মতো বলে তাপস। সবাই চুপ হয়ে যায় এই কথা শুনে। তারপর তাপস মায়ের কাছে এসে বলে,
-” অত চিন্তা করো না। পিউই তোমার ছেলের বৌ হবে। একটু সময় দাও আমাকে। “
তারপর বাবার কাছে এসে বলে,
-” তোমায় যেমন অপমান করে গেছেন, তেমনি তোমার বাড়িতে এসেই তোমার হাত ধরে ক্ষমা চাইবেন। “
-” কিভাবে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন রাজীববাবু।”
তাপস হেসে বলে,
-“ধৈর্য্য ধরো, ধৈর্য্য ধরো। “
কথাটা বলেই তাপস চলে যায়, ওর নিজের ঘরে।
এরপর দিন ১৫ কেটে গেছে। তাপস ফোন করে না, পিউও ফোন করে না। হটাৎ একদিন তাপস পিউদের বাড়ি গেলো। তার আগের দিনই অলোক ফিরেছে বাঙ্গালোর থেকে একদম চাকরি নিয়ে। এখানে দিন ২০ থেকে তারপর কাজে জয়েন করবে।তাপস কলিং বেল বাজাতে অলোক দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। তাপসকে দেখে বলে,
-” আরে তাপস দা যে কি ব্যাপার?”
-তোমার বাবার সাথে কথা ছিল। তিনি আছেন?” – তাপস বলে।
অলোক বলে,
-” তা বাইরে কেন? ভেতরে এসো?”
বলেই অলোক পিছন ঘুরে ডাক দে,
-” বাবা – ও বাবা তুমি কোথায়?”
রান্নাঘর থেকে পিউ বেরিয়ে এসে বলে,
-” কে রে ভাই?”
সামনে তাপসকে দেখে থমকে যায় পিউ। অলোক বলে,
-” তাপস দা বাবার সাথে দেখা করবে। বাবা কোথায় রে দিদি?”
পিউ কিছু না বলে চলে যায়। মামিমা পিছনে এসেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন,
-” তোর বাবা তো শোবার ঘরে শুয়ে আছেন। “
তাপস এগিয়ে এসে বলে,
-“শরীর খারাপ নাকি? তবে থাক আজ। “
মামিমা বলেন,
-” না না বাবা। আসলে বয়স হয়েছে তো, বেশিক্ষন বসে থাকতে পারেন না। শুয়ে পড়েন। তুমি যাও ঘরে। অলোক তাপসকে নিয়ে যা তোর বাবার কাছে। “
বলে মামিমা ঘরে ঢুকে গেলেন। অলোক নিয়ে গেলো বাবার কাছে। তাপস যেতেই বিজয়বাবু উঠে বসলেন।
-” ভালো আছেন কাকাবাবু?”
বলে তাপস প্রণাম করলো বিজয়বাবুকে। বিজয়বাবু শুধু একটু মাথায় হাত দিলেন। মুখে কিছু বললেন না। তাপস আবার বলল,
-” আপনার কাছে আজ আসিনি কাকাবাবু। আপনি একটু পিউকে ডেকে দিন, ওর সাথেই কথা আছে। তবে আপনার সামনেই কথাটা বলবো।”
বিজয়বাবু কিছু বলার আগেই অলোক,
-” এক্ষুনি ডাকছি পিউদিকে।” বলেই ছুটে বেরিয়ে যায়। একটু পরেই পিউকে হাত ধরে টেনে আনতে আন্তে বলে,
-” আরে আয় না, তাপস দা কিছু কথা বলবে তোকে; আয়। “
ঘরে এসে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ে পিউ। অলোক পিউকে টেনে আনছে দেখে মামিমাও পিছন পিছন আসেন। সবাইকে আসতে দেখে তাপস বলে,
-” কাকাবাবু আপনি আমার ওপর রাগ করবেন না। “
তারপর পিউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আমি আগামী পাঁচ দিন পর U.S.A. চলে যাচ্ছি, বেটার চান্স পেয়ে।
তুমি কেন কালনা কলেজে জয়েন করবে? আমি চলে গেলে, আমাদের কলেজেই তো যোগ দেওয়ার কথা। বাড়ির কাছে যেমন হতো, তেমন মাইনেও বেশি হতো।”
একটু চুপ করে থেকে তাপস আবার বলে,
-” কালনা কলেজে অনেক দূর। বাসে, ট্রেনে যেতে হবে। মাইনেও কম। তাছাড়া কোন সকালে বেরিয়ে সেই রাত্রে বাড়ি ফেরা। বাড়িতে এই দুটো বয়স্ক মানুষকে একলা ফেলে যাওয়া। ভেবে দেখো।”
মামা মামীর কানে তাপসের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাটা খট করে লাগে। আর পিউ? বুকের মধ্যে যেন এক ঝলক রক্তক্ষরণ হয়। জ্বালা দিয়ে ওঠে মুচড়ে ওঠে বুক। বড়ো বড়ো চোখ করে বিজয়বাবু তাকান তাপসের দিকে। মামিমা বলেন,
-” সেকি বাবা। তুমি দেশ ছেড়ে, বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ?”
তাপস মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলে,
-” বেটার চান্স; আর তাছাড়া মাইনেও অনেক বেশি।”
-” একটুও কষ্ট হবে না,সবাইকে ছেড়ে যেতে।” আবার প্রশ্ন করেন মামিমা।
-“কষ্ট? একেবারেই যে হবে না, তা নয়। ও আস্তে আস্তে সব সহ্য হয়ে যাবে।” কথাটা বলে চোখে জল চলে আসে তাপসের। অলোক তাপসের কাছে বসে হাত দুটো ধরে বলে,
-” না তাপস দা তুমি যেও না। কেন যাবে?কার জন্য যাবে? বলো? তোমার দেশ, তোমার আত্মীয় স্বজন ছেড়ে; তোমার বাবা, মা, দাদা, বৌদি সবাই রোজগার করছে। তোমার দরকার কি? বলো?”
উঠে দাঁড়িয়ে তাপস বললো,
-” হ্যাঁ কাল কলেজে আমায় ফেয়ারওয়েল দেওয়ার জন্য সব ছাত্র- ছাত্রীরা মাইল ফুঁশন করবে বলেছে। তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ রইলো। সবাই যেও। কাকাবাবু আপনিও যাবেন। ” বলে চলে যায় তাপস। (emotional sound end) (serious sound start)
বিজয়বাবু পাথরের মতো বসে থাকেন। বেশ কিছুক্ষন পর পিউও আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে যায়। অনেক্ষন পর মামিমা চিৎকার করে বলে ওঠেন,
-” জানিস খোকা তোর বাবাই ছেলেটাকে দেশ ছাড়া, ভিটে ছাড়া করলো। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য। নিজের পেনশনের টাকা আছে, রোজগেরে ছেলে আছে, তা স্বত্বেও ভাগ্নির পয়সার খাওয়ার এতো শখ, যে মেয়েটার ভবিষ্যৎটা অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলো। “
পিউকে ওদের বাড়ির বৌ করবে বলে, তাপসের বাবা অতো বোরো ব্যারিস্টার মানুষ তোর বাবার হাত ধরেছিলো। আর উনি মুখের ওপর না করে দিয়ে এসেছেন।”
হাঁপাতে হাঁপাতে মামিমা বসে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-” আমার সাত জন্মের মহা পাপ যে অমন স্বামী পেয়েছি। ওই মেয়েটার টাকাতেই শ্যামলীর বিয়ে হলো। তোর পড়াশোনাও হলো। কিন্তু ওই পোড়ারমুখী কি পেলো? না ভাগ্য করে এক স্বার্থপর মামা। যাকে নাকি ও বাবা বলে জানে। হয় ভগবান। ”
আলোক বাবার কাছে এসে বলে,
-” তুমি এই রকম বাবা? আমার ওপর তোমর কোনো ভরসা নেই? তাই পরের মেয়েকে আটকে রেখে দিয়েছো; নিজে সুখে থাকবে, নিজের ভবিষ্যৎকে ভালো রাখবে বলে! তবে কেন জন্ম দিয়েছিলে আমায়? মেরে ফেলো?”
বলেই বিজয়বাবুর দুটো হাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরে বলে,
-” গলা টিপে মেরে ফেলো। তুমি আবার স্কুল মাস্টার, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দাও। ছিঃ ছিঃ।”
কাঁদতে থাকে অলোক। বিজয়বাবু ছেলের হাতদুটো ধরে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-” বিশ্বাস কর, এতদূর হবে আমি ভাবতে পারিনি। তাপস যে এতো ভালোবাসে পিউকে বুঝতে পারিনি।”
একটু থেমে আবার বলেন বিজয়বাবু,
আমি ভবেছিলাম বড়োলোকের ছেলে; দু- তিন দিনের শখ। আর তাছাড়া পিউ মা আমার ঘরের লক্ষী। ও আস্তে আমার ঘর ভোরে উঠেছে। প্রাণ ধরে কি করে ওকে পরের ঘরে যেতে দি।”
অলোক বলে,
-” এসব তোমার ভ্রান্ত ধারণা। ওর কাছ থেকে নিতে নিতে তোমার অভ্ভাশ হয়ে গেছে। তাই দিতে তোমার মন চায় না।” তুমি কিপ্টে। লোকে তোমায় ওই জন্যই কিপ্টে বলে, ঠিকই বলে।”
মামিমা বলেন,
-” আমি আর ওকে মুখ দেখাতে পারবো না। সারা জীবন মেয়েটা শুধু দিয়েই গেলো। ওকে আমরা কিছু দিতে পারলাম না।”
বিজয়বাবু বলেন,
-” আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। আমি একটা ব্যবস্থা করবোই। দেখো ঠিক একটা ব্যবস্থা করবো।”
পরের দিন পিউদের বাড়ির সবাই কলেজের অনুষ্ঠানে গেল। সকালে শ্বশুরবাড়ি থেকে শ্যামলীও এসেছে। পিউ কিছুতেই কলেজে যেতে রাজি হয়নি।শুধু কাঁদছে। শ্যামলী বুঝিয়ে – সুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। কলেজে যেতেই সবাই পিউকে ছেকে ধরলো। পিউ তোকে গান গাইতেই হবে। পিউ না না করেই যাচ্ছে। যাইহোক ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান আরম্ভ হলো। ফুলের মালা দিয়ে অভ্যর্থনা করা হলো। অনেকে অনেক গিফট দিলো। তারপর একটা গান গাইতে বললো। তখন তাপস সামনের চেয়ারে বসে থাকা পিউয়ের তাকিয়ে একটা গান ধরলো।
-” হামে তুমসে প্যায়ার কিতনা
ইয়ে নেহি জানতে–
মাগর জি নেহি সাকতে
তুম্হারে বিনা।”
বিজয়বাবু দেখলেন, অনুষ্ঠানে তাপসের বাড়ির লোক কেউ আসেনি। তখন আস্তে আস্তে বেড়িয়ে গেলেন, কলেজ থেকে। তাপসদের বাড়ির সামনে এসে একটু ইতঃস্তত করে ভিতরে ঢুকে গেলেন।সামনে রাজীব বাবুর চেম্বার। উঁকি দিয়ে দেখলেন, রাজীব বাবু একাই চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। বিজয় বাবু ছুটে গিয়ে রাজীব বাবুর চেয়ারের কাছে হাঁটুমুড়ে বসে পড়লেন; বললেন,
-” স্যার।”
চম্কে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন রাজীব বাবু , “এ কি করছেন বিজয়বাবু উঠুন উঠুন ” বিজয়বাবু রাজীববাবুর হাত ধরে বললেন -” আমায় ক্ষমা করুন ক্ষমা করুন,আমি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি “
“ঠিক আছে আপনি উঠুন, উঠে চেয়ার এ বসুন ” রাজীব বাবু বিজয় বাবুকে ধরে তুলে চেয়ার এ বসালেন।
তারপর বললেন – “এখন আর এ ভুল সংশোধন হবে কি আমার জানা নেই “
তবে চলুন আমরা একবার কলেজের প্রোগ্রাম এ যাই দেখি ওখানে কি হচ্ছে ,তারপর চেষ্টা করবো ওদের দুজনকে এক করার ”
শুধু দুজনেই নয় তাপসদের বাড়ির সবাই গেলো প্রোগ্রামে। সবাই যখন পৌঁছায় তখন পিউ স্টেজে গান করছে
“ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে
জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশী ভালোবাসি ভালোবাসি। “
স্টেজের পাশে পিউ এর দিকে তাকিয়ে তাপস দাঁড়িয়ে আছে। গান শেষ হতে ওরা স্টেজ থেকে নামল। বিজয় বাবু এগিয়ে যায় ওদের কাছে ,পিউ এর হাত তাপসের হাতে তুলে দিয়ে বলে -” তোমার হাতে আজ থেকে আমার পিউ এর ভার দিলাম, ওকে তুমি দেখো ” পেছনে রাজীব বাবু দাঁড়িয়ে সম্মতির হাসি হাসছেন। পিউ আর তাপস রাজীব বাবু ও বিজয় বাবু কে প্রণাম করলেন। প্রোগ্রাম শেষে ২ পরিবার তাপসদের বাড়ি এলেন।
সবার মুখে হাঁসি ,যেন চাঁদের হাট।
মামীমা তাপস কে বলে – “তুমি আর তাহলে বাইরে যাবেনা তো তাপস “?
রাজীব বাবু বলেন – মাথা খারাপ নাকি আর কখনো বাইরে যেতে দিই।,তবে এখানে তো রিজাইন লেটার দেওয়া হয়ে গেছে সেটার জন্য কাঠ খড় পোড়াতে। আর পিউ মা কে এখন চাকরি করতে দেবোনা ,ও আগে পি এইচ ডি করবে তারপর ।”
তুহিন বলে ওঠে -“সবার আগে বিয়ে। ”
সবাই একসাথে হেসে ওঠে।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | কাবেরী ঘোষ |
Intro & Ending | Olivia Das |
কথক | Priyanka Dutta |
Characters | Name |
---|---|
তাপস | Souradip Roy |
পিউ | Olivia Das |
তুহিন | Debanshu Ghosh |
তাপসের বাবা | Souradip Roy |
পিউয়ের মা | Susmita Ghosh |
পিউয়ের মামা | Suman Sadhukhan |
পিউয়ের মামী, ঝর্ণা ও পৃথা | Priyanka Dutta |
তাপসের মা ও শ্যামলী | Olivia Das |
তন্ময় ও অলোক | Joydeep Lahiri |
Find us on Facebook – click here