এক গোছা রজনীগন্ধা

Views: 5
এক গোছা রজনীগন্ধা:
এক বসন্তের সকালে শ্রীরামপুরের আকাশে ধূপের সুগন্ধ আর গাঁদা ফুলের মালার মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। সরস্বতী পুজোর আর মাত্র দুদিন বাকি, আর পাড়ার সবাই প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। পুষ্পেন্দু তার চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বইয়ের স্তূপ নিয়ে লোকাল ক্লাবে যাচ্ছিল, যেখানে সে বার্ষিক পুজোর আয়োজনের স্বেচ্ছাসেবক।
পঁচিশ বছর বয়সী পুষ্পেন্দু পাড়ায় শান্ত, বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ছিল – বিদ্যা ও শিল্পের দেবী সরস্বতীর ভক্ত হিসেবে এটা খুবই মানানসই। সে কাছের একটি কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়াত এবং সন্ধ্যাবেলায় গরিব ছাত্রদের টিউশন দিত । এবছর তাকে সরস্বতী পুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
সেদিনই প্রথম তার সঙ্গে দেখা। পূর্ণিমা ক্লাবে এল বীণা নিয়ে, লম্বা কালো চুল একটি আলগা বেণীতে বাঁধা, পরনে সাদা সূতির সালোয়ার কামিজ। সে সম্প্রতি এই পাড়ায় এসেছে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়েছে। তার উপস্থিতিতে এমন কিছু ছিল যা সাধারণত পুষ্পেন্দুকে প্রথম কথোপকথনে হকচকিয়ে দিয়েছিল।
“শুনলাম সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের জন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী খুঁজছেন,” পূর্ণিমা বলল,
তার কণ্ঠস্বর তার হাতের বাদ্যযন্ত্রের মতোই সুমধুর। “আমি বীণা বাজাই এবং বারো বছর ধরে শিক্ষা নিচ্ছি।”
পুষ্পেন্দু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, নিজের আবেগ সামলানোর চেষ্টা করে। “আপনাকে অনুষ্ঠানে পেলে আমরা সম্মানিত হব। আপনি কি এখানে অনুশীলন করতে চান? আমাদের একটা ছোট রিহার্সাল রুম আছে।”
পরেরদিন পুষ্পেন্দু নিজে নিজেই রিহার্সাল রুমে যাওয়ার অজুহাত খোঁজে। সে সবার জন্য চা নিয়ে আসে, সাউন্ড সিস্টেম ঠিক করে, বা শুধু “সব ঠিক আছে কিনা” দেখার জন্য পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। প্রতিবার, সে পূর্ণিমার দিকে চোখ পড়তেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
সরস্বতী পুজোর আগের দিন, পূর্ণিমা একা রিহার্সাল করছিল। বীণার তারে তার আঙুলের স্পর্শে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভেসে আসছিল – “আমি চঞ্চল হে”। পুষ্পেন্দু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিল, যখন হঠাৎ পূর্ণিমা তাকে দেখে ফেলল “এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন?” পূর্ণিমা জিজ্ঞেস করল।
“আপনার বীণার সুরে হারিয়ে গিয়েছিলাম,” পুষ্পেন্দু স্বীকার করল। “রবীন্দ্রনাথের এই গানটি আমার খুব প্রিয়।”
“আমারও,” পূর্ণিমা মৃদু হেসে বলল। “আপনি কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গান?”
এভাবেই শুরু হল তাদের আলাপচারিতা। দুজনেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা, সাহিত্য, সঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে বলতে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলল। পূর্ণিমার বাবা-মা ছিলেন শিক্ষক, আর সেও সঙ্গীত শিক্ষক হতে চায়। পুষ্পেন্দুর সাহিত্য প্রেম আর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার গল্প শুনে তার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল।
পুজোর দিন সকালে, পূর্ণিমা সাদা শাড়ি পরে এল। তার চোখে কাজল, পায়ে আলতা, – দেখে মনে হচ্ছিল যেন সাক্ষাৎ সরস্বতী। পুষ্পেন্দু তার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কথা বলার সাহস পেল না।
সন্ধ্যায় পূর্ণিমার পরিবেশনা শুরু হল। তার বীণার সুরে সবাই মুগ্ধ। পুষ্পেন্দু স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। যখন পূর্ণিমা “আমার ভুবন মন উদাসী” বাজাচ্ছিল, তখন তাদের চোখাচোখি হল। সেই মুহূর্তে দুজনেই বুঝল, তাদের হৃদয়ে যে সুর বাজছে, তা একই।
অনুষ্ঠান শেষে, যখন সবাই চলে যাচ্ছিল, পুষ্পেন্দু পূর্ণিমার কাছে গিয়ে বলল, “আপনার বাজনা শুনে মনে হল, মা সরস্বতী নিজেই এসেছিলেন।”
পূর্ণিমা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। “আপনি অতিশয়োক্তি করছেন।”
“না,” পুষ্পেন্দু দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। “আমি ঠিক বলছি। আর…” সে একটু থেমে বলল, “আপনাকে কিছু বলার ছিল।”
পূর্ণিমা তার দিকে তাকাল, তার চোখে প্রত্যাশার আভাস।
“আমি জানি আমরা মাত্র কয়েকদিন আগে দেখা করেছি। কিন্তু মনে হয়, আপনাকে অনেক দিন ধরে চিনি। আপনার সঙ্গে কথা বলে, আপনার বীণার সুর শুনে, আপনার ভাবনার সঙ্গে নিজের ভাবনার মিল খুঁজে পেয়ে…” পুষ্পেন্দু একটু থামল। “আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি,বলেই পূর্ণিমার সামনে তুলে ধরলো এক গোছা রজ্ঞনীগন্ধা।”
পূর্ণিমার চোখে জল এল। “আমিও,” সে মৃদু স্বরে বলল। “আপনার সাহিত্য প্রেম, শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা, সবার প্রতি সহানুভূতি – এসব দেখে আমিও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
সেদিন সন্ধ্যায়, মা সরস্বতীর সামনে, দুটি শিল্পপ্রেমী হৃদয় একাকার হয়ে গেল। বাইরে হালকা শীতের হাওয়ায় ভেসে আসছিল ধূপের গন্ধ আর বীণার সুর, আর দুজনের হৃদয়ে বাজছিল প্রেমের অনাদি সঙ্গীত।
পরের বছর সরস্বতী পুজোয়, পুষ্পেন্দু আর পূর্ণিমা একসাথে পুজোর আয়োজন করল। তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন তারা দুজনে মিলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেয়, সন্ধ্যায় সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চা করে। তাদের জীবনে সরস্বতী পুজো শুধু একটি উৎসব নয়, তাদের প্রেমের স্মৃতি।
শারদ ঋতুর এক শুভ লগ্নে পুষ্পেন্দু আর পূর্ণিমার বিয়ে হল। বিয়ের মণ্ডপ সাজানো হয়েছিল শ্বেত পদ্ম আর লাল গোলাপে। পূর্ণিমা লাল বেনারসি শাড়িতে যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। পুষ্পেন্দু তার টোপর সামলাতে সামলাতে বারবার চুপি চুপি তাকাচ্ছিল পূর্ণিমার দিকে।
বিয়ের পরে তারা একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট নিল। ড্রয়িং রুমে পূর্ণিমার বীণা আর পুষ্পেন্দুর বইয়ের আলমারি। বারান্দায় তুলসী গাছ আর টেবিল রাখা ফুলদানি তে এক গোছা রজ্ঞনীগন্ধা । প্রতি সন্ধ্যায় পূর্ণিমার বীণার সুরে আর পুষ্পেন্দুর কবিতা পাঠে মুখরিত হত ঘর।
দুজনেই তাদের পেশায় সফল হল। পূর্ণিমা একটি বিখ্যাত সঙ্গীত বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হল, আর পুষ্পেন্দু কলেজের অধ্যাপক। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল তাদের ছোট্ট সংসার। সপ্তাহান্তে দুজনে মিলে রান্না করত, বই পড়ত, সঙ্গীত চর্চা করত।
পাঁচ বছর পর তাদের ঘরে এল মেয়ে সায়নী। পূর্ণিমার মতোই সুন্দর, পুষ্পেন্দুর মতোই বুদ্ধিমান। ছোট্ট সায়নী মায়ের বীণার সুরে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়ত, বাবার কোলে বসে রবীন্দ্রনাথের ছড়া শুনত।
বছর কেটে যায়। সায়নী বড় হয়। পূর্ণিমার চুলে পাক ধরে, পুষ্পেন্দুর চশমার পাওয়ার বাড়ে। কিন্তু তাদের ভালোবাসা যেন আরও গভীর হয়। প্রতি সরস্বতী পুজোয় তারা সেই প্রথম দেখার কথা মনে করে। পূর্ণিমা এখনও সেই “আমি চঞ্চল হে” বাজায়, আর পুষ্পেন্দু এখনও সেই মুগ্ধ শ্রোতা।
সায়নীও বড় হয়ে মায়ের কাছে বীণা শেখে, বাবার কাছে সাহিত্য। সে এখন কলেজে পরে, এমনই এক সন্ধ্যায় পুষ্পেন্দু আর পূর্ণিমা একদিন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল।
“মনে আছে,” পুষ্পেন্দু বলল, “সেই প্রথম যেদিন তোমাকে দেখলাম? তুমি বীণা নিয়ে ক্লাবে এসেছিলে?”
পূর্ণিমা হাসল। “কেমন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলে। কথাই বের হচ্ছিল না।”
“আর আজও তোমাকে দেখলে সেই একই অনুভূতি হয়।”
পূর্ণিমা স্বামীর হাত ধরল। “জানো, মা সরস্বতী আমাদের কত বড় আশীর্বাদ করেছেন। সঙ্গীত, সাহিত্য, শিক্ষা – সব কিছু দিয়ে আমাদের জীবন ভরিয়ে দিয়েছেন।”
“শুধু তাই নয়,” পুষ্পেন্দু বলল, “তিনি আমাদের পরস্পরের জীবনে এনেছেন। এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কী হতে পারে?”
সন্ধ্যা নামল। বারান্দায় রজনীগন্ধার সুবাস ছড়াল। ভেতর থেকে ভেসে এল সায়নীর বীণার সুর। পুষ্পেন্দু আর পূর্ণিমা পরস্পরের হাত ধরে বসে রইল। তাদের চোখে প্রেম, হৃদয়ে শান্তি, আর জীবনে সঙ্গীতের অনন্ত সুর।
সেই যে সরস্বতী পুজোর দিন দুটি হৃদয়ের মিলন হয়েছিল, তা শুধু একটি গল্পের শুরু ছিল। আসল গল্প তো এই – যেখানে প্রেম, শিল্প, আর জীবন এক হয়ে গেছে। যেখানে সঙ্গীতের সুর আর কবিতার ছন্দ মিলে একাকার হয়ে গেছে। যেখানে পুষ্পেন্দু আর পূর্ণিমার ভালোবাসা হয়ে উঠেছে একটি চিরন্তন সুর।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Joyedeep Lahiri |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Olivia Das |
Characters | Name |
---|---|
Puspendu | Joyedeep Lahiri |
Purnima | Priyanka Dutta |
Find us on Facebook – click here