ফিরে আসা
Views: 0
ফিরে আসা:
ঘটনা সত্য কিন্তু পাত্র পাত্রীর নাম কিছু আনুসঙ্গিক অদল বদল আছে। কিন্তু মহাদেবের কৃপা আছে|
একই রকম ঘটনা ঘটে ছিল কেদারনাথ ধামে। পরিবারটি কলকাতার। স্বামী অবিনাশ, স্ত্রী শ্যামলী আর একটি ছোট্ট মেয়ে মিমি বেড়াতে গিয়েছিল কেদারে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল অবিনাশের যে চার ধাম একবারে ঘুরবে। ব্যাঙ্কে চাকরী করে অবিনাশ। দায়িত্বশীল পদেই। তাই ইচ্ছা থাকলেও সখ মেটে না। যাই হোক্ আপাততঃ একটা একটা করেই হোক। দিনক্ষন দেখে ভাল ভাবে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে একদিন পরে এসে হরিদ্বার এসে পৌঁছাল। সেখানে একদিন থেকে কেদারনাথ ধামের উদ্দেশ্যে রওনা হল। কিন্তু আকাশ গোন্ডগোল করছে। বেশ মেঘ করে বৃষ্টি শুরু হলো।
যাই হোক, কেদারনাথ ধামে এসে পৌঁছাল। একটা হোটেল ভাড়া করল। সেখান থেকে মন্দির মিনিট পনেরো রাস্তা। বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। বরঞ্চ আরো জোরে বৃষ্টি হতে লাগল। সবার মুখে চিন্তার ছাপ।
ছোট্ট মেয়ে মিমি। তারও চিন্তা, বলে, – ‘‘কি হবে বাবা। আমরা মন্দিরে যেতে পারবো না?’’
অবিনাশ হেসে বলে, – ‘‘দূর বোকা। আমাদের সাথে রেইন কোট আছে। ছাতা আছে। চিন্তা কি! ঠিক যেতে পারবো। বাবা কেদারনাথ ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।’’
চিন্তা দূর হয় মিমির মন থেকে। কিন্তু শ্যামলীর মনে চিন্তার বাঁধ ভেঙ্গেছে।
সে বার বার অবিনাশকে বলে, – ‘‘কি দরকার এই বৃষ্টিতে বের হবার। ঐ সরু রাস্তা, এক পাশে নদী আর এক পাশে পাহাড়। বৃষ্টি না থামলে আমি বেরোবো না। যতই ছাতা থাকুক আর রেইন কোট থাকুক। আমার আর মিমির রেইন কোট আছে তোমার তো নেই।’’
অবিনাশ বলে, – ‘‘অত চিন্তা করো না। আমি ছাতা নিয়ে বেরুবো। মনে করো না যে এটা একটা এ্যাড্ভ্যাঞ্চার হবে।’’ বলে হা-হা-হা করে হেসে ওঠে।
যাই হোক সেদিনটা বেরোলো না কেউ। কিন্তু বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। চারিদিকে জল-এ জলোময়। পাশে সরু নদীটা এখন যেন রাক্ষসীর মতোন ছুটে চলেছে। কি ভীষণ স্রোত। পাহাড়ী নদী স্রোতের টানে যেন ফুলে ফুলে উঠছে। দেখলেই বুকের ভিতরটা যেন কেঁপে ওঠে।
পরের দিন সকালে অবিনাশ ঘরে পায়চারি করতে করতে বলে, – ‘‘ঘরে বসে থাকবো বলে কি এলাম। যা হোক করে যাই চলো।’’
বলে বসাই বেরোলো। অবিনাশ ছাতা নিয়ে চললো। বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারে রাস্তা চলা খুব শক্ত। খুব হাওয়া, তার সাথে বৃষ্টি। রাস্তা পিচ্ছল্। পা টিপে টিপে ফেলতে হচ্ছে। এবরো খেবরো রাস্তা সাবধানে পা ফেলে চলতে হচ্ছে। অবিনাশের এ হাতে ছাতা আর এক হাতে মেয়ের হাত ধরে আছে। অবিনাশের পা একবার হড়কাতে সামলে নেয় সে।
শ্যামলীকে ডেকে বলে, – ‘‘শ্যামলী মেয়ের হাত ধরো। ছাতা এক হাতে সামলাতে পাচ্ছি না।’’
শ্যামলী মেয়ের হাত ধরে। আস্তে আস্তে সব এগোয়। আরো কিছু যাত্রী আগুপিছু আছে। একটা চাতাল মতো জায়গায় শ্যামলী মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় অবিনাশের ছাতা উল্টে যায়। দু হাতে ছাতা সামলাতে গিয়ে পা হড়্কে যায়। চিৎকার করে ওঠে – ‘‘শ্যামলী’’ শ্যামলী পিছন ফিরে দেখে অবিনাশ নদীতে পড়ে গেছে। শ্যামলী চিৎকার করে ওঠে ‘‘বাঁচাও’’।
অবিনাশ চেঁচিয়ে বলে ওঠে, – ‘‘আমি ফিরে আসবো। তোমরা সাব…..।’’ কথা শেষ হয় না। স্রোতের টানে ভেসে যায় অবিনাশের শরীরটা। হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে শ্যামলী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। আশেপাশে আরো সব যাত্রী হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে কারোর মুখে কথা নেই। সবার চোখে জল। হায় হায় করতে থাকে সবাই|
কালের স্রোতে ভেসে যায় ১১টা বছর। মিমি এখন ২১ বছরের তরুনী। কলেজে পড়ে। বাবার কথা ওর মাঝে মাঝে মনে পড়ে। মনে হয় ছুটে চলে যায় বাবার কাছে ঐ কেদারনাথ ধামে। এখনো বোধ হয় বাবা তারই জন্য পথ চেয়ে বসে আছে।
শ্যামলীও শূন্যবুকে বসে ভাবে কোথা থেকে কি হয়ে গেল। এখন আর আশা করে না সে। অবিনাশ ফিরে আসবে। তবে সেদিন-এর পর থেকে আর কেদারনাথের নাম ওর মুখে আসে না। কিন্তু অবিনাশের নামের মানে তো – যার বিনাশ নেই, সেই অবিনাশ। তবে ওর জীবন-এ কেন এত তাড়াতাড়ি বিনাশ এসে গেলো।
শ্যামলী কেদারনাথ দামে যাত্রা করার আগে অবিনাশকে বলেছিল, ‘‘আমার মেয়ের কোলে ছেলে হলে বাবা ভোলানাথকে রূপোর ত্রিশূল বানিয় দেবো। “
সে স্বপ্ন সে আশা চুরমার হয়ে গেল। তার সংসার সাজানো হলো না। যাই হোক সেই থেকে শ্যামলীও কোনও যাবার নাম করে না।
মিমি বলে, – ‘‘ জানো মা আমাদের কলেজ থেকে আমার দু তিন জন প্রিয় বন্ধু আর তাদের বাবা মা সবাই বেড়াতে যাচ্ছে। আমাকেও বলছে মিমি তুইও চল্ মাকে নিয়ে ঘুরে আসবি।”
হাসতে হাসতে শ্যামলী বলে, – ‘‘বেশ তো চল্। ঘুরে আসি। কতদিন হলো কোথাও যাই নি। তা কোথায় যাবেন ওঁনারা?’’
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, – ‘‘ওরা চারধাম যাবে।’’
“না না যেতে হবে না। বাদ্ দে। চল্ তুই আর আমি অন্য কোথাও যাই।’’
মিমি কাছে এগিয়ে এসে মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলে- “ আমিও বলেছি চারধাম নয়, শুধু কেদার নাথেই যাবো। ওরা অন্য ধামে যায় যাক্।”
ছিট্কে ওঠে শ্যামলী। বলে, – ‘‘কি দরকার তোর কেদারনাথে যাবার। মনে নেই তোর কিছু বাবার কথা।”
মিমি বলে, – ‘ঐ জন্যই তো যাবো। বাবার শেষ কথাটা আর মনে আছে। “আমি ফিরে আসবো।’’ যদি আবার আসে ফিরে। হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’’
শ্যামলী বিরক্ত হয়ে বলে, – ‘‘কেন আজে বাজে কথা বলছিস্। ফিরে আসলে এত দিনে কি কোন ভাবে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতো না। থানায় হোটেলে আমাদের সব ডকুমেন্ট তো দিয়ে এসেছি। তবে?’’
মিমি মুখ ভার করে চলে যায়। রাত্রে খায় না। অগত্যা সকালে শ্যামলী জানায় সে কেদারনাথ ধামে যাবে তবে আর কোথাও নয়। হাসি ফোটে মিমির মুখে।
তিন মাস পর অক্টোবরের শেষে একদিন কেদারনাথ ধামের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু শ্যামলীর মুখ ভার হয়ে আছে,যা বলছে তার উত্তর দিচ্ছে। বাকি সময় চুপচাপ। জলছবির মতো সব ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেদার নাথ ধামে পৌঁছে হোটেল ভাড়া করে। যে যার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করছে। মিমি আর শ্যামলী একটা ঘরে ঢোকে।
মিমি বলে, – ‘‘মা, ফ্রেস হয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে কাল মন্দিরে যাবার প্ল্যান করবো।’’
বলে মিমি ফ্রেস হতে যায়। ফিরে এসে দেখে শ্যামলী যেমন বসেছিল ঠিক তেমনী বসে আছে।
– ‘‘আচ্ছা মা’’ মুখ হাতপা মুছতে মুছতে বলে, – ‘‘তুমি যদি এই ভাবেই থাকবে তো , আমার একা আসাই ভাল ছিল। আমায় একা আসতে দিলেও না, আবার নিজেও জড়ভরত হয়ে বসে আছো। এমনি করলে ভাল লাগে?’’
চমকে শ্যামলী বলে, – ‘‘না না এইতো যাচ্ছি।’’ বলে উঠে পড়ে।
পরের দিন। আবার বেঁকে বশে শ্যামলী। সে মন্দিরে যাবে না।
মিমি বলে, – ‘‘মা, তোমার রাগ দুঃখ, অভিমান ভুলে বাবার মন্দিরে চলো তোমার ভালো লাগবে। ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য।’’
চোখ বড় বড় করে শ্যামলী ঠাস্ করে মিমির গালে এক চড়্ মেরে দেয়। ‘‘বলে, – ‘‘তোর বাবা মারা গেছেন তোর কাছে মঙ্গল হয়েছে?’’
গালে হাত দিয়ে মিমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কোনদিন মা তার গায়ে হাত তোলেনি। কিন্তু আজ মা একি করলো। শ্যামলীও চমকে যায়। একি করলো সে। মেয়েকে মারলো। মিমি আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায়। অন্যদের সাথে মন্দিরে যাবে।
আস্তে আস্তে শ্যামলীও যায়। সবাই মন্দিরে ঢোকে। শ্যামলী ঢুকে মন্দিরে মূর্তির সামনে বসে। সে কি কান্না। দুচোখের বাঁধ মানে না। যত দুঃখ রাগ অভিমান বেদনা সব গলে জল হয়ে যেন দু চোখ দিয়ে পড়ছে।
মিমি মাকে ধরে আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ির শেষ ধাপে বসিয়ে বলে, – ‘‘এখানে বসো আমি জল নিয়ে আসছি।’’
শ্যামলী তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। হঠাৎ সামনে একটা ১০/১১ বছরের ছেলে এসে দাঁড়ায়। হাতে একগোছা ফুল। চমকে ওঠে শ্যামলী।
কানে এসে লাগে যেন অবিনাশ বলছে – ‘‘এই নাও ফুল’’।
সামনে দেখে একটা ১০/১১ বছরের ছেলে। কি সুন্দর দেখতে। মায়াভরা মুখ। গায়ে একটা ময়লা ফুলহাতা জামা আর পরনে হাফপ্যান্ট। শ্যামলীকে দেখছে আর হাসছে। এমন সময় মিমি এসে একটা জলের বোতল দিয়ে বলে, – ‘‘একটু জল খাও।’’
ছেলেটি দেখে হিন্দিতে বলে, – ‘‘হ্যাঁ, মাকে যত্ন করো। তোমার নাম মিমি না?’’
শ্যামলী মিমি অবাক, বলে, সেও হিন্দীতে – ‘‘তুমি কে?’’
– ‘‘আমি দুখিয়া’’ হেসে বলে ছেলেটি হিন্দীতে, – ‘‘তোমার মা শ্যামলী, তোমরা কলকাতায় থাকো!’’
মুখের কথা বন্ধ হয়ে যায় দু মায়ের মেয়ের।
ছেলেটি আবার বলে, – ‘‘আমার আগের জন্মের নাম ছিল অবিনাশ। এ জন্মের দুখিয়া। আমি বলেছিলাম আমি ফিরে আসবো। এই দেখো এসেছি।’’ বলেই ছেলেটি দৌড়ে চলে যায় অন্য দিকে। মিমি ধরতে যায়। ডাকে কিন্তু শোনে না ছেলেটি।
শ্যামলীর মাথায় কিছু ঢোকে না। ভাবে এইটুকু ছেলে কি ভাবে জানলো ওদের কথা। এ কে?
অনেকক্ষন পরে মিমি চিন্তা করে বলে, – ‘‘দেখেছো মা আমি বলে ছিলাম ঈশ্বর মঙ্গলময়। বাবা ঠিক ফিরে এসেছে। আর ঠিক আমাদের খুঁজে বার করেছে। আমার মন ঐ জন্য এখানে আসার জন্য টানছিল।’’
শ্যামলী বলে, – ‘‘কি বলছিস্ তুই। এই ছেলেটি তোর…..।’’ কেঁদে ফেলে শ্যামলী।
মিমি বলে, – ‘‘তুমি ধরতে পারলে না। ছেলেটি জাতিস্বর। গত জন্মের কথা ওর মনে আছে সব। আর আমাদেরকে চিনতেও পেরেছে। চলো দেখি খোঁজ নিই। ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবো।’’
মিমি আর শ্যামলী দেখে কিছু দূরে একটা বৌ ফুল বিক্রি করছিলো। তাকে হিন্দীতে মিমি জিজ্ঞাসা করলো, দুখিয়ার কথা।
ফুলওয়ালী বৌটি হিন্দীতেই বলল, – ‘‘ও দুখিয়া বেটা। খুব ভাল ছেলে। জন্ম দিয়েই ওর মা মরে গেল। আর বাপটা কোথায় পালিয়ে গেল ওকে ফেলে।’’
মিমি জিজ্ঞাসা করে – ‘‘ও থাকে কোথায়?’’
ফুলওয়ালী বৌটা বলে, – ‘‘ঐ খানিক গিয়ে নীচে একটা মিষ্টির দোকান আছে ওখানে থাকে। ওদের কাজ করে দেয়, খেতে পায়। ওরা দেখে।’’
শ্যামলী চারিদিকে তাকাতে তাকাতে দেখতে পায় মন্দিরের পিছনে এক সাধু বসে ধ্যান করছে। সেখানে গিয়ে শ্যামলী সাধুবাবাকে সব বলে জিজ্ঞাসা করে, – ‘‘এ ও কি সত্যি হয় বাবা?’’ আমার স্বামী একটা বাচ্চা ছেলে হয়ে এসেছে?’’
সাধুবাবা সব শুনে, একটু ধ্যান করে বলেন, – ‘‘হ্যাঁ বেটী, এই তোর স্বামী। নদীর স্রোতে ভেসে গিয়ে ও বাঁচে নি। কিন্তু তোদের চিন্তায় ওর মন ব্যাকুল ছিল। তাই কেদারনাথজির দয়ায় পুর্ণজন্ম লাভ করে আবার তোদের কাছে এসেছে।’’
পরের দিন শ্যামলী আর মিমি ঐ মিষ্টির দোকানদারের কাছে এসে ওকে চেয়ে নেয়। সঙ্গে নিয়ে একদম কলকাতায় আসে।
মিমি বলে, – ‘‘তুমি আমার বাবা ঠিকই কিন্তু তোমায বাবা বলে ডাকলে লোকে অনেক প্রশ্ন করবে। ভালও লাগবে না, তাই তোমাকে আমি বাপি বলে ডাকবো। আর তোমার এ জন্মে মেয়ের মতন নয় দিদি হয়ে থাকবো।’’শ্যামলীও স্বামী বলে জানলেও দুখিয়াকে ছেলের মতন মানুষ করতে লাগল। কেদানাথের কাছে মিনতি ছিল ছেলে হলে ত্রিশূল দেবে। তাই কেদারনাথ মনস্কামনা পূরণ করেছে।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Kaberi Ghosh |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathok | Olivia Das |
Characters | Name |
---|---|
Abinash | Debanshu Ghosh |
Shamoli | Shamoli |
Dukhiya | Soumik Banerjee |
Mimi (Choto) | Tanisha Ghosh |
Mimi (Boro) | Priyanka Dutta |
Sadhu Baba | Joydeep Lahiri |
Find us on Facebook – click here