গভীর রাতে

Views: 2

গভীর রাতে:

প্রফুল্ল বাবু তার বোনের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। অনেকদিন আসেন নি। কাজের চাপে সময় পান নি। তাই কাজ থেকে ছুটি নিয়ে দুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন। প্রফুল্ল বাবু বিয়ে করেন নি। তাই ওনাকে সংসার নিয়ে কোনোদিন তেমন ভাবতে হয় নি। উনি কলকাতায় একটি মেসে থাকেন। ওনার ভাগ্নে সুবোধ ওনাকে খুব ভালোবাসে। সুবোধ দের গ্রামের পাশের গ্রামে একটি মেলা বসে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে। অনেক রাত অবধি যাত্রা হয়। কত লোক আসে। নাগরদোলা বসে। সে এক বিরাট ব্যাপার। সুবোধ তার সব আবদার তার মামার কাছেই করে। সুবোধ ভালো করে জানে যে তার মামা তার কথা ফেলতে পারবে না। তাই সুবোধ বায়না ধরলো যে সে তার মামার সাথে মেলা দেখতে যাবে। প্রফুল্ল বাবুর বোন শোভা দেবী অনেক বুঝিয়েও ছেলেকে শান্ত করতে পারলেন না। তখন প্রফুল্ল বাবু বললেন,

-” ঠিক আছে ভাগ্নে, তোকে আমি নিয়ে যাব। তবে একটা কথা এখন তুই পাঠশালায় গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।”

সুবোধ আনন্দের সাথে বলে উঠলো,

-” হ্যাঁ, মামা। আমি খুব মন দিয়ে আজ পড়াশোনা করে আসব। পণ্ডিত মশাই কিছু বলতেই পারবেন না।” এই কথা বলে সুবোধ চলে গেলো।

সন্ধ্যায় প্রফুল্ল বাবু সুবোধ কে নিয়ে মেলায় গেলেন। ঠাকুর দর্শন করে, প্রসাদ ও গরম জিলিপি খেয়ে সুবোধ বায়না ধরলো পুরো যাত্রা দেখে তবে সে বাড়ি যাবে। সে বলেই চললো,

-” ও মামা, মামা, ওই দেখো শিব ঠাকুর আর পার্বতী মা হয়েছে দুজন। কি সুন্দর করে ওরা যাত্রা করছে। আর একটু থাকি। এখন বাড়ি যাব না।” 

প্রফুল্ল বাবু মহা বিপদে পড়লেন। এদিকে রাত বাড়ছে। এরপর আর ফেরার কোনো উপায় থাকবে না। গরুর গাড়ি গুলো আস্তে আস্তে কমে আসছে। উনি একরকম উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,

-” ওরে সুবোধ বাড়ি চল। এরপর হেঁটে হেঁটে ফিরতে হবে নইলে। দেখছিস না সবাই আস্তে আস্তে ঘরের পথ ধরছে।”

সুবোধ তা শোনার পাত্র নয়। সে তো যাত্রার শেষ অবধি না দেখে কিছুতেই বাড়ি যাবে না।

যাত্রা শেষ হতে হতে প্রায় অনেক রাত হয়ে গেলো। মেলা চত্বরে আস্তে আস্তে লোক কমছে। মন্দিরে এখনো পুজো চলছে। সুবোধ প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল মামার কোলে। প্রফুল্ল বাবু তাকে ডেকে তুললেন,

-” ভাগ্নে ও ভাগ্নে, বাড়ি চল বাপ। ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে।” 

সুবোধ ঘুম চোখেই হাঁটতে শুরু করলো। প্রফুল্ল বাবু যা ভেবেছিলেন তাই হল। পথে কোনো গরুর গাড়ি পেলেন না। অনেকটা পথ। কি করে বাড়ি ফিরবেন সেটাই ভাবছেন এমন সময়ে পিছন থেকে একজন ডাকল,

-” কি মশাই বাড়ি ফিরছেন নাকি?”

প্রফুল্ল বাবু বললেন,

-” হ্যাঁ। সেরকমই বলতে পারেন। আসলে আমার ভাগ্নে সুবোধ এমন যাত্রা দেখবে বলে বায়না করলো যে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেলো। এখন তো কিছুই পাব না। তাই হাঁটা ছাড়া গতি কি?”

লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখা গেলো না। সে আবার বলল,

-” আপনি এক কাজ করুন। আমার বাড়ি চলুন। কাছেই। ছোট্ট ছেলেটাকে দেখে মায়া হচ্ছে। এত রাতে একে নিয়ে কোথায়ই বা যাবেন? তার থেকে বরং কাল সকাল হলেই ফিরবেন।”

প্রফুল্ল বাবু বললেন,

-” না ভাই। এত রাতে লোককে বিরক্ত করতে চাই না। আমরা চলে যেতে পারবো। আসছি।”

প্রফুল্ল বাবু হাঁটা লাগালেন।

হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছেন। এবার বেশ ক্লান্ত লাগছে। ওদিকে মাঝপথে সুবোধ কে কোলে নিয়ে নিয়েছিলেন। সুবোধ এখন কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটা কুঁড়েঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। দাওয়া তে একটা লন্ঠন ঝুলছে আর একজন সেখানে বসে ঝিমোচ্ছে। প্রফুল্ল বাবু তাকে ডাকলেন

-” শুনছেন মশাই?” 

লোকটা মুখ তুলে দেখে বললো,

-” কে আপনি? এত রাতে এইখানে কেন? মরতে বুঝি?”

প্রফুল্ল বাবু বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললেন,

-“কোথায় একটা লোককে একটা বাচ্চা নিয়ে দেখে সাহায্য করার চেষ্টা করবে তা নয় উল্টে ভুলভাল কথা বলছে। আজব লোক তো!!”

লোকটাকে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন,

” আসলে আমরা মেলা দেখতে এসেছিলাম। বুঝতে পারিনি এত রাত হয়ে যাবে। আপনি যদি একটা কোনো থাকার জায়গা বলে দেন তাহলে আজ রাতটুকু এই বাচ্চা টা কে নিয়ে থাকতাম।”

লোকটা খুব জোরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,

-” তার যে চোখ পড়েছে আপনাদের ওপর। আজ যদি বেঁচে যান তাহলে সেটা ভোলেবাবার কৃপা। তবে সে আপনাদের ছাড়বে না।” 

প্রফুল্ল বাবু এবার রেগে গিয়ে বললেন,

” ধুর মশাই, আপনাকে কতক্ষণ ধরে সাহায্য করতে বলছি আর আপনি রসিকতা করছেন। তখন থেকে কার কথা বলছেন বলুন তো?”

লোকটা তার চোখ দুটো বড় বড় করে বললো,

-” সে রক্তশোষক পিশাচ। মানুষের ঘাড় মটকে রক্ত চুষে তাকে মৃত্যুর কোলে পাঠিয়ে দেয়,আমি তার কথাই বলছি। ওই দেখো আকাশ কেমন ঘন মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। অন্ধকার আরো গাঢ় হচ্ছে। সে আসছে। পালাও, পালাও।” 

এই কথা বলে লোকটা সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো। প্রফুল্ল বাবু কাউকে আর দেখতে পেলেন না। উনি আবার হাঁটতে শুরু করলেন। এদিকে হাওয়ার বেগ বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তায় একটা জনপ্রাণী নেই। ছোট্ট সুবোধ কে নিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। শরীরে শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। হালকা ভয় লাগতে শুরু করেছে। তবু ভগবান কে ডাকতে ডাকতে তিনি এগিয়ে চললেন।

তিনি যখন প্রায় তাদের গ্রামের সীমান্তে চলে এসেছেন ঠিক সেই সময় তিনি একটা পরিচিত গলা শুনতে পেলেন,

” কি মশাই এখনো হেঁটে চলেছেন? আপনাকে ভাল পরামর্শ দিয়েছিলাম কিন্তু আপনি শুনলেন না। ওখানে আমার বাড়িতে থাকলে আপনার এত কষ্ট হতো না।”

প্রফুল্ল বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন,

” আপনাকে আমি চিনি না। তাই অযাচিত ভাবে আপনার এই উপকার আমি নেব কেন? আর আপনিই বা এখানে কখন এলেন? আপনাকে তো এতক্ষণ দেখতে পাইনি।”

লোকটা ধীরে ধীরে বললো,

” শিকারের খোঁজে। আজ শিকার করব আমি। কতদিন কতদিন আমি খিদের জ্বালায় ছটফটিয়ে মরেছি। আজ আমি শান্তি পাব শান্তি।”

প্রফুল্ল বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন,

” এ তো মহা মুশকিল হল। ও মশাই কি সব বলছেন বলুন তো! আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না। এখন আমাকে যেতে দিন তো। রাস্তা ছাড়ুন।”

লোকটা কেমন যেন হিংস্র হাসি হেসে বললো,

” যেতে দেবো বলে তো পথ আটকাই নি। তোর তো আজ মুক্তি নেই। তোর যে সময় আগত। এবার তুই মরবি।” 

সম্বোধনটা হঠাৎ তুই তে বদলে যাওয়ায় প্রফুল্ল বাবু থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। লোকটা তখন তার মুখের আবরণ সরিয়ে দিয়েছে। তার মুখের দিকে চাইতেই প্রফুল্ল বাবুর হাড় হিম হয়ে গেলো। চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। হাতের আঙুলের নখ গুলো রাক্ষসের মত বিশাল বড় বড়। হাসি দেখলে মনে হয় এখনই প্রাণটা মনে হয় বেরিয়ে যাবে। ওই লোকটা একটা পৈশাচিক হাসি হেসে বললো,

” অনেকদিন পর দুটো তাজা প্রাণ পেয়েছি। আজকে তোদের কে দিয়েই আমি আমার রক্তের পিপাসা মেটাবো। কতদিন মানুষের রক্তের স্বাদ পাই নি। আজ আমার জ্বালা মিটবে।”

প্রফুল্ল বাবু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তারপর হুঁশ ফিরতে তিনি দৌড়াতে যাবেন এমন সময়ে হঠাৎ তার গলাটা চেপে ধরলো সেই পিশাচ । হাসি তার থামছে না। সুবোধ ঘুম থেকে উঠে ভয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। প্রফুল্ল বাবু কিছুতেই নিজের গলা ছাড়াতে পারছেন না। উঃ কি অসম্ভব যন্ত্রণা! এই বুঝি প্রাণ টা বেরিয়ে গেলো। সুবোধ কে তিনি যন্ত্রণায় মাটি তে ফেলে দিয়েছেন। সেই মানুষ খেকোটা তার গলায় কামড় বসিয়ে সব রক্ত শুষে নিচ্ছে। তার শরীরে আর বিশেষ জোর নেই। তিনি সুবোধ কে ডাকতেও পারছেন না। তার সারা শরীর অবসণ্ণ হয়ে আসছে। এক সময়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তারপর সেই লোকটা একটা হাসি হেসে বাচ্চা সুবোধ কে নিজের কোলে তুলে নিলো। তারপর তার ঘাড় মটকে রক্ত চুষে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো প্রফুল্ল বাবুর পাশে। মামা আর ভাগ্নে রাস্তার পাশে পড়ে রইলো। আর সেই লোকটা যে রাতের অন্ধকারে দুটো নিষ্পাপ জীবনের সমাপ্তি ঘটালো সে আবার নিজেকে লুকিয়ে নিলো এই সাধারণ মানুষের ভিড়ে। আবার কেনোদিন সে ফিরে আসবে তার পরবর্তী শিকারের গন্ধে।

ভোরের আলো ফুটেছে। পাখি ডাকতে শুরু করেছে। কিন্তু মামা আর ভাগ্নে দুজনে তখন চির নিদ্রায়। তাদের জাগানোর সাধ্য পৃথিবীর কারোর নেই।

 

Audio Story Starts From Here:

Story InfoName
WriterTrisha Laha
Intro & EndingDebanshu Ghosh
KathakOlivia Das
CharactersName
SubodhDebanshu Ghosh
Profullo BabuJoydeep Lahiri
PisachDebanshu Ghosh

Find us on Facebook – click here

আরো পড়ুন

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *