জীবনদাতা কে?

Views: 0

জীবনদাতা কে? :

বহু যুগ আগে, এই দেশে এক রাজা বাস করতে। রাজা খুব বিচক্ষণ, বুদ্ধিদ্ধমান, ও সুবিবেচক। রাজার বয়স ছিল অল্প, রাণীও অল্প বয়সী। রাজার নাম ছিল কল্যান। রাজার কোন সন্তানাদি ছিল না। তার জন্য  রাজার ও রানীর কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না। যখন হবার তখন হবে। এখন এত মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই। এই ভাবে হেসে খেলে দিন কেটে যায়। দেখতে দেখতে ১০টা বছর পার হয়ে গেলো।

রাজা রানী প্রতি মাসে এক-একটা মন্দিরে যান। পূজা, হোম যজ্ঞ করেন। আবার রাজ্যে ফিরে আসেন।  এই ভাবে দিন যায়। মাস যায়। বছরও যায়। এবার রাণীর

মনে চিন্তা দখা দেয়। তবে কি আমাদের কোন সন্তান হবে না। রানীর চিন্তা দেখে রাজাও চিন্তা করেন। আরো ২ বছর গেল, এবার রানী কান্নাকাটি আরম্ভ করে। এ কবিরাজ সে করিবাজ করেন। এ জ্যোতিষী সে জ্যোতিষী করে। সবাই বলে হ্যাঁ হবে।

কিন্তু না রাজা রানী কোন সন্তানের মুখ দেখতে পায় না। এ মাসে রাজা রানী একটা দূরের মন্দিরে যান।

পূজা পাঠ হোম যজ্ঞ সেরে রাজ্যে ফেরার মুখে এক তান্ত্রিক, কালী সাধকের দেখা পান। বিশাল তাঁর চেহারা তেমন  জলদ গম্ভীর গলার আওয়াজ, রাজা রাণীকে দেখে বিকট অট্টহাসি হাসালেন, হা-হা-হা। সে আওয়াজে মন্দিরের ছাদে বসা সব পাখিরা উড়ে গেল। হাসি থামিয়ে বলে,

-“সুন্দর বিচক্ষণ বুদ্ধিমান ছেলে পাবি তবে –”

থামেন তন্ত্রিক। কি যেন ভাবেন। রাজা তাড়াতাড়ি বলেন,

-“কি করতে হবে তান্ত্রিক ঠাকুর। যা বলবেন তাই করবো।”

একটু চুপ করে থেকে অন্ত্রিক বলেন,

-‘ পারবি তুই? সন্তান পার ঠিক তোর মতন। -“পারবি তো? তাহলে বুদ্ধিমান,বিচক্ষণ, সন্তান পাবি তুই ঠিক তোর মতন…..তবে…..।”

-“তবে কি ঠাকুর, বলুল।”

আগ্রহ ভরে জিজ্ঞাসা করেন রাজা। তান্ত্রিক বলেন,

-“দেখি তোর বুদ্ধি আর বিচক্ষনতা। হ্যাঁ- কতগুলি শর্ত আছে।”

রাজা ভাবেন। হঠাৎ অন্ত্রিক ঠাকুর আমার বুদ্ধি আর বিচার বিচক্ষণতার কথা কেন বলছেন। যাই হোক বলেন,

-“কি শর্ত ঠাকুর?”

তান্ত্রিক চোখ বুজে কিছু ভেবে বলেন,

-” একটি ১২ বছরের কিশোর চাই। “ঠিক ১২ বছর। দেখতে সুন্দর হবে। কর্মঠ হতে হবে। সত্যবাদী ও সাহসী হবে। নামের প্রথম অক্ষর ‘স’ হবে।

এমন ছেলে কি তোর রাজ্যে আছে? খুঁজে পাবি?”

-“চেষ্টা করব ঠাকুর; খুঁজলে নিশ্চই পাওয়া যাবে। তারপর?” বলেন রাজা।

স্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তান্ত্রিক রাজার দিকে তার পর চাপা গলাম বলেন,

-” ঠিক রাত বারটায় ওকে বলি দিতে হবে,হাড়ি কাঠে মাথা দিয়ে।”

চমকে ওঠেন রাজা। আঁৎকে উঠে ছিঁটকে প

সরে যান। ভয়ার্ত্ত স্বরে বলেন,

-“না- না। পারবো না, ক্ষমা করুন। আমার সন্ধান চাই না।”

রানী এতক্ষণ চুপ করে সব কথা শুনছিল, এই কথা গুলো শুনে “মাগো” বলে জ্ঞান হারায়। ছুটে যান রাজা রানীর কাছে। অন্ত্রিক- হা-হা-হা করে হেসে ওঠেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তান্ত্রিক চলে যাবার উপক্রম করতে রাজা ছুটে যান তান্ত্রিকের কাছে। বলেন,

-“ক্ষমা করুন ঠাকুর। এই অমানুষিক কাজ এই নিষ্ঠুর কাজ আমার দ্বারা হবে না।”

-“তাহলে আমার পথ আটকালি কেন? আমায় যেতে দে।”

বলে তান্ত্রিক আবার পা বাড়ায়। জ্ঞান ফিরে পেয়ে রানী কাঁদতে থাকে; বলে

 -“ঠাকুর একি কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন। দয়া করুন।”

তান্ত্রিক বলেন, 

” আমি দয়া করলেও, ঈশ্বর তো তোদের দয়া করবেন না। তাহলে তো এতোদিনেই দয়া করতেন। ”

কিছুক্ষন রাজা কিছু ভেবে বললেন,

-“বেশ ঠিক আছে ঠাকুর আপনি যা-যা বলেছেন, আমি সব ঠিক করবো?” 

মুচকি হেসে তান্ত্রিক বলে,

-“ঠিক আছে। আগামী অমাবস্যায় সব ঠিক করে ফেল। আমি যাবো। মায়ের পূজা করবো, ওই পুজোয় ওই বলি হবে। এতেই তোর পূণ্য হবে আর তোর সন্তান হবে। ” বলেই তান্ত্রিক চলে যায়।

স্থবিরের মতন বেশ কিছুক্ষণ রাজা বসে কি ভাবলেন, তারপর রানীকে নিয়ে রাজ্যের দিকে ফিরে চললেন। কিশোর জন্য ঢেঁরা পেটালেন। কর্মঠ হতে হবে। সত্যবাদী ও সাহসী হতে হবে। রাজ্যের লোক সবাই অবাক হয়ে গেলো।একি রাজার, দুর্বুদ্ধি হল। পুজোতে মানুষ বলি দেবে? তার ওপর শিশু ? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। রাজ্যের লোক  যাদের ১২ বছরের ছেলে আছে;  তারা তাদের ছেলে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়; নাহয় তাদের বয়স মিথ্যা বলার। টাকা পয়সা সম্পত্তির লোভ দেখালেও কেউ রাজি হয়না। কোন বাবা মা নিজের ছেলেকে বলি দিতে ছেড়ে দেয়। ছি ছি ছি  রাজ্যের লোক ভাবে আমাদের রাজা কত ভালো ছিল, আর নিজের সন্তানের জন্য অন্যের সন্তান বলি দেবে? রাজার লোক চারিদিকে খোঁজে ১২ বছরের ছেলে কোথায় আছে।  কিন্তু কিছুতেই পায় না। শেষে খুঁজে পাওয়া গেলো; তান্ত্রিক ঠাকুর যেমন চেয়েছিলেন।

সত্যবাদী, সাহসী, কর্মঠ, সুর্দশন, বুদ্ধিমান। ছেলের নাম সুবর্ণ। একেবারে রাজ্যের শেষে থাকে এক মুচি। এক মেয়ে। আর চার ছেলে। মেয়ে বড় ১৬ বছর বয়স, তার আবার রূপ দেখে এই রাজ্যে সেনাপতির ছেলের পছন্দ। বিয়ে হবে। কিন্তু টাকা পয়শা নেই। মুচির আবার তিন দিন ধরে- অসুখ। সংসার চলে না। তারপরের ছেলে সুর্বন। সে বাবার কাজ করে সারা দিন ধরে। কোন মতে এক বেলা খেয়ে থাকে। বাবার অসুখের জন্য ওষুধ আনার চেষ্টা করে।

তারপরে তিনটে ভাই ছোটা ছোটো। তাদের পড়াশোনা আছে, দিদির বিয়ের টাকার জোগাড় আছে। এদিকে বাবা বিছনায়। নিচু জাত বলে, কেউ সাহায্য করতে চায় না।  

এ হেন সময়ে মুচিকে কে এসে রাজার কথা জানাতে‌ মুচির-মনে আশা জাগে। মুচি তখন  রাজার ছেঁড়া ধরে, সবাই অবাক হয়ে যায়। মুচি বিছানা থেকে উঠে, ছেলেকে বোঝায়। মা কাঁদে, দিদি কাঁদে, ভাই বোনেরা কাঁদে । সুবর্ন  ভাবে তাইতো, -তার জীবন-দিয়ে যদি এত গুলো জীবন বাঁচে, তাতে অসুবিধা কোথায়। সে যাবে,বাবা ঠিক বলেছে নিশ্চই সে যাবে। দিনের দিন  সুবর্ন গিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করে বলে, সে রাজার শর্তে রাজি। তবে তারও একটা শর্ত আছে। রাজা বলেন,

-“বেশ তোমার কি শর্ত আছে বলো।”  

সুবর্ণ বলে, 

-” বলির আগে আমায় খুব সুন্দর পোষাক পরাতে হবে আর চারটে মাটির বল দিতে হবে। আমি মরার আগে পুজো করবো।”

রাজা বলেন,

-“বেশ- তাই হবে।” 

তান্ত্রিক কালীপুজা করবে। তাই গৃহে নয় বাগানে পুজার ব্যবস্থা হয়েছে। এদিকে সন্ধ্যা বেলায় রাজসভায়  সুবর্ন নতুন পোষাক পরে পুজো করতে বসে। পুজোতে কোন আড়ম্বর নেই। ধূপ-ধূনা,মালা চন্দন কিছুই নেই। শুধু আসনে বসে মনে মনে হাত জোড় করে  চোখ বুজে কি যেন বলে।সামনে চারটে মাটির বল। একটাতে একটা জবা ফুল,সামনে সবাই বসে, রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি আরো

অনেকে। আর বাইরে বাগানে তান্ত্রিক পূজোর আয়োজন করছেন রাত ১২টায় বলি। সুবর্ণের মুখমণ্ডল গম্ভীর। কিন্তু বেশ উজ্জ্বল। কোনো ভয়ের লেশ নেই। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন,

-, “সুবর্ন তোমার ভয় করছে না?”

সুবর্ন হেসে বলে,

– “না”।

-“আমার ওপর রাগ হচ্ছে না।” রাজা প্রশ্ন করেন।

“কেন রাগ হবে রাজা মশাই? একটা জীবন নিয়ে একটা জীবন পেতে চান আপনি।” 

একটু থেমে আবার বলে,

-“এই যে আমার সামনে চারটে মাটির বল দেখছেন। এর একটা আমার মা, যিনি আমায় জীবন দিয়েছেন, তিনি আমার প্রথম রক্ষা কর্ত্রী। কিন্তু না তিনি চোখের জলে আমায় বিদায় দিলেন। তাই ভেঙ্গে দিলাম।” 

বলেই একটা মাটির বল ভেঙ্গে দিলো। তারপর বলে,

-” পরেরটা বাবা, স্নেহ ভালবাসায় পরম আদরে-লালন পালন করেছেন, তিনি রক্ষা করতে পারলেন  না। অভাবের জ্বালায় আমায় বিক্রী করে দিলেন, তাই এটাও ভেঙ্গে দিলাম।” 

বলেই পরের বলটা ভেঙ্গে দিলো সুবর্ণ। তারপর আবার বলে,

-” এই তৃতীয়টা দেশের রাজা, শেষ রক্ষা কর্তা তিনি। যার দেশের প্রজাদের সুখ সুবিধা ভালো মন্দ দেখার কথা। আজ আমার কপাল, সেই দেশের রাজার স্বার্থে আমায় মরতে হচ্ছে। তাই এটাও ভেঙ্গে দিলাম।” 

বলেই পরের বলটা ভেঙ্গে দিলো। রাজসভায় সবার চোখে জল, এমনকি রাজারও। আবার সুবর্ণ বলে,

-” এই শেষ বলটা- এই বলটা দেবতার উদ্দ্যেশ্যে। শেষ রক্ষা কর্তা তিনি। মা কালীর নামে ফুল দিয়েছি। বাবা মা রাজা কেউ রক্ষা করেনি করবেও না। মা কালী যাঁর কাছে বলি দেবেন। তিনি যদি সত্যই মা হন তাহলে আমার রক্ত তিনি নেবেন না। তিনি আমায় রক্ষা করবেনই।” 

বলেই হাত জোড় করে মাকে ডাকতে লাগল। দু চোখ বেয়ে জলের ধারা। কিছুক্ষণ পর,

হঠাৎ কোথা থেকে এল প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টি। কি ঝড়। সব লন্ড ভন্ড করে দিলো নিমেশে। মনে হচ্ছে জলে ভেসে যাবে দেশ-টা। সবাই ছুটো ছুটি করতে লেগেছে। সব উড়ে ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সুবর্ণ ঠিক  অমন ভাবেই বসে রইলো। গাছ পালা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, যেন প্রকৃতি প্রচন্ড রাগে ফুঁসছে। এমন অবস্থায় রাজা রানীর কাছে ছুটে যান। রানীও ভয়ে ঘরের কোনে চুপ করে বসে মা কালীকে ডাকছে। রাজাকে দেখে রানী বলে,

-” আমার ভালো লাগছে না রাজামশাই, আপনি এ বলি বন্ধ করুন। সুবর্ণকে বাঁচান।”

রাজাও মাথা নাড়েন।  হঠাৎ রাজার মনে পড়ল তান্ত্রীকের কথা। সঙ্গে সঙ্গে রাজসভায় এসো দাঁড়ান। দেখেন ভয়ে সবাই একসাথে জড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। চারি দিকে লন্ড ভন্ড  হয়ে গেছে জিনিসপত্র। আলো নেই।

কারো মুখে কথা নেই। শুধু শুধু ঝড় বৃষ্টির আওয়াজ শোঁ-শোঁ, আর মাঝখানে সুবর্ণ  হাত জোড় করে‌ বসে। তার দুচোখে জল।

রাজা মন্ত্রিকে ডেকে বললেন,

-” মন্ত্রী, দেখুন তো তান্ত্রীক ঠাকুর কোথায়। পূজোর অবস্থা কি হল?” 

মন্ত্রী বলে,

-“রাজা মশাই বাইরে যাবার উপায় নেই। রাজ সভার বাইরে বাকি লোকজন সব দাড়িয়ে। বাগানে জলের স্রোত বইছে, গাছপালা‌ উড়ে উড়ে পড়ে  রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।” 

রাজা বললেন,

-” তাই তো।” 

তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ঘণ্টা দুয়েক পড়ে হটাৎ যেমন ঝড়বৃষ্টি এসেছিল, তেমনই হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি থেমে গেল। চারি দিকে আলো জলে উঠল। সবাই দেখে সুবর্ণ-এর সামনে যে মাটির বলটার ওপর ফুল ছিল তা এত  হাওয়াতেও পড়ে যায় নি, ঠিক তেমনটি আছে। আর ঠিক সেই সময় একজন সৈন্য এসে, রাজার হাতে একটা-চিঠি দিল। রাজা তাড়াতড়ি খুলে পড়লেন, তাতে লেখা

“রাজা তোমার সুযোগ্য পুএ হলো এই‌ সুবর্ন, একে‌

যত্নে লালন পালন করো। তলায় লেখা তান্ত্রিক।

রাজা ছুটে এসে সুবর্ণকে জড়িয়ে ধরে। খবর পেলে রানীও ছুটে আসে সভায়‌, সুবর্ণকে পরম মাতৃস্নেহে‌ জরিয়ে ধরে। রাজসভায় সবার মুখে হাসি ফুটে‌ ওঠে।

Audio Story Starts From Here:

Story InfoName
WriterKaberi Ghosh
Intro & EndingDebanshu Ghosh
KathakOlivia Das
CharactersName
RajaSuman Sadhukhan
RaniSusmita Ghosh Das
TrantrikDebanshu Ghosh
SubornoJoydeep Lahiri
MantriSoumik Banerjee

Find us on Facebook – click here

আরো পড়ুন

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *