কার্শিয়াংয়ের অভিশাপ
Views: 0
কার্শিয়াংয়ের অভিশাপ:
কার্শিয়াংয়ের পাহাড়ি এলাকায় একটি পুরনো বাংলো বাড়ি। গাঢ় সবুজ চা বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়িটি, যেন কালের সাক্ষী হয়ে। বছর খানেক আগে এই বাড়িটি কিনেছেন কলকাতার ব্যবসায়ী অনিমেষ সেন। স্ত্রী মধুমিতা আর মেয়ে অনন্যাকে নিয়ে তিনি এখানে থাকতে এসেছেন, শহরের কোলাহল থেকে দূরে শান্তিময় জীবনযাপনের আশায়। অনিমেষ বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করার সময় বললেন,
-“মধুমিতা, দেখো কী সুন্দর বাড়ি! এখানে আমরা নতুন জীবন শুরু করব।
মধুমিতা উত্তর দিলেন,
-“হ্যাঁ, কিন্তু একটু পুরনো মনে হচ্ছে না? আশা করি সব ঠিকঠাক আছে।”
প্রথম দিকে সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। রাতে অস্পষ্ট কান্নার শব্দ, দরজা জানালা আপনা থেকে খুলে যাওয়া, ঘরের জিনিসপত্র নিজে থেকে সরে যাওয়া – এসব দেখে অনিমেষ আর মধুমিতা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এলো অনন্যার মধ্যে।অনন্যা,অনন্যা হলো মধুমিতা আর অনিমেষ এর মেয়ে সে যেন আর আগের মতো নেই। হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেছে, একা একা কথা বলে, রাতে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে। এরই মধ্যে রাতে এক অদ্ভুত শব্দ শুনে অনন্যা চিৎকার করে উঠল,
-“বাবা! মা! কে যেন কাঁদছে!”
অনিমেষ মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,
-“কিছু না মা, হয়তো বাতাসের শব্দ।”
পরেরদিন সকালে মধুমিতা উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,
-“অনিমেষ, অনুর আচরণ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। আমি চিন্তিত।”
অনিমেষ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
-“হয়তো নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। ঠিক হয়ে যাবে।”
একদিন মধুমিতা দেখলেন, অনন্যা বাড়ির পেছনের বাগানে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। যখন অনন্যা বাগানে কারো সাথে কথা বলছিল, মধুমিতা জিজ্ঞেস করলেন,
-“অনু, কার সাথে কথা বলছিস?”
কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই অনন্যা বললো,
-“মা, তুমি ওকে দেখতে পাচ্ছো না? ওই যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে।”
মধুমিতা চারপাশে তাকালেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন।
পরদিন অনিমেষ স্থানীয় লোকজনের কাছে খোঁজ নিলেন। জানতে পারলেন, এই বাড়িটির একটা ইতিহাস আছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এখানে থাকতেন এক ব্রিটিশ চা বাগান মালিক। তার ছিল এক বাঙালি স্ত্রী আর একটি মেয়ে। কিন্তু হঠাৎ একদিন সেই মেয়েটি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। তারপর থেকেই নাকি এই বাড়িতে অশুভ শক্তির বাস।
অনিমেষ এসব বিশ্বাস করেননি। কিন্তু অনন্যার অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। সে এখন প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যায়, কখনো কখনো অন্য কারো মতো কথা বলে। একদিন সে হঠাৎ করে ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করলো, যা সে কখনো শেখেনি।
মধুমিতা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলেন অনন্যাকে। ডাক্তার বললেন, এটা মানসিক রোগ হতে পারে। কিন্তু চিকিৎসায় কোনো ফল হলো না।
হতাশ হয়ে অনিমেষ একজন স্থানীয় ওঝার সাথে যোগাযোগ করলেন। ওঝা এসে বাড়িটা দেখে বললেন,
-“এখানে একটা আত্মা আছে। সেই আত্মা আপনার মেয়ের মধ্যে ঢুকে গেছে।”
স্থানীয় ওঝার সাথে কথা বলার পর অনিমেষ বললেন,
–
-“মধুমিতা, এসব কুসংস্কার। আমি বিশ্বাস করি না।”
মধুমিতা দৃঢ়স্বরে বললেন,
-“কিন্তু অনুর অবস্থা দেখছ না? কিছু একটা তো করতে হবে!”
মেয়ের কথা ভেবে অনিমেষবাবু ওঝার কথাতে রাজি হয়ে যায়।ওঝা একটি আচার অনুষ্ঠান করলেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হলো না। বরং সেই রাতে অনন্যা আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠলো। সে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
-“আমাকে বাঁচাও! আমি যেতে চাই না!”
পরের দিন সকালে অনন্যাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সারা বাড়ি তোলপাড় করে খোঁজা হলো। শেষে তাকে পাওয়া গেল বাড়ির পেছনের পুরনো কুয়োর কাছে। সে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিল।
এরপর অনিমেষ ঠিক করলেন, এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে। তিনি স্থানীয় পুরনো বাসিন্দাদের কাছ থেকে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলেন। জানতে পারলেন, সেই ব্রিটিশ মালিকের মেয়েটির নাম ছিল এমিলি। তার মা ছিলেন বাঙালি। এমিলি নাকি খুব সুন্দর গান গাইতে পারত।
একদিন অনন্যা হঠাৎ করে একটা পুরনো বাংলা গান গাইতে শুরু করলো।
মধুমিতা অবাক হয়ে শুনলেন, কারণ এই গানটা তিনি তার ঠাকুরমার কাছে শুনেছিলেন। অনন্যা এই গান কোথায় শিখলো?
অনিমেষ তখন একজন peranormal investigator এর সাহায্য নিলেন, যিনি পুরনো ঘটনা নিয়ে investigate করেন। investigator বাড়িটা ঘুরে দেখলেন, পুরনো কাগজপত্র খুঁজলেন। শেষে তিনি একটা দলিল পেলেন যেখানে লেখা ছিল, এমিলির মৃত্যুর কথা। কিন্তু সেখানে মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল না।
investigator আরও খুঁজে বের করলেন যে, এমিলির বাবা তাকে ইংল্যান্ডে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমিলি যেতে চায়নি। সে এখানকার একজন ভারতীয় ছেলেকে ভালোবাসতো।
এই তথ্য পেয়ে অনিমেষ বুঝলেন, হয়তো এমিলি আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু কেন?
কিছুদিন পর আবার অনন্যা এমিলির আত্মা দ্বারা আবার আক্রান্ত হল, সে কেঁদে বলল,
-“আমাকে বাঁচাও! আমি যেতে চাই না!”
অনিমেষ ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুমি কে? কেন এসেছ?”
ঠিক তখনই অনন্যা আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লো। যখন জ্ঞান ফিরলো, সে অন্য কারো মতো কথা বলতে লাগলো,
“আমি এমিলি। আমাকে বাঁচাও। আমি মরতে চাই না।”
অনিমেষ ধীরে ধীরে এমিলির সাথে কথা বলতে লাগলেন। জানতে পারলেন, এমিলি তার প্রেমিককে হারানোর ভয়ে আত্মহত্যা করেনি। তার বাবা তাকে জোর করে ইংল্যান্ডে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সে দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যায়। তার বাবা এই ঘটনা চেপে যান, কারণ তিনি চাননি যে কেউ জানুক তার মেয়ে পালাতে চেয়েছিল। এমিলির আত্মা শান্তি পায়নি, কারণ তার মৃত্যুর সত্য কথা কেউ জানতো না। সে চেয়েছিল যে সবাই জানুক তার সাথে কী হয়েছিল।
সবার সাথে কথা বলার পর অনিমেষ বললেন,
-“মধুমিতা, আমরা এমিলির সত্যি গল্প জানতে পেরেছি। এবার কি করা উচিত?”
মধুমিতা প্রস্তাব দিলেন,
-“আমরা এমিলির স্মৃতিতে একটা অনুষ্ঠান করি। হয়তো তাতে তার আত্মা শান্তি পাবে।”
অনিমেষ তখন স্থানীয় লোকজনকে ডেকে এমিলির গল্প শোনালেন। তারপর এমিলির স্মৃতিতে একটি অনুষ্ঠান করলেন, যেখানে সবাই মিলে প্রার্থনা করলেন যাতে তার আত্মা শান্তি পায়।
অনুষ্ঠানের পর, সেই রাতে অনন্যা গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো। পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, সে যেন নতুন করে জন্ম নিয়েছে। তার চোখে মুখে আবার হাসি ফুটে উঠলো। যখন অনন্যা সুস্থ হয়ে উঠল, সে বলল,
-“বাবা, মা, আমি যেন স্বপ্নে দেখলাম। এমিলি এখন শান্তিতে আছে।”
অনিমেষ আর মধুমিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারা বুঝলেন, এমিলির আত্মা এতদিন পরে শান্তি পেয়েছে।
অনিমেষ আর মধুমিতা এই ঘটনা থেকে অনেক কিছু শিখলেন। তারা বুঝলেন, প্রত্যেক মানুষের গল্প শোনা দরকার, এমনকি তারা যারা আর এই পৃথিবীতে নেই। কারণ প্রত্যেকের জীবনের পেছনে একটা গল্প থাকে, যা শোনা উচিত।
তারা এই বাড়িটিকে এখন আর ত্যাগ করতে চান না। বরং এটাকে তারা নতুন করে সাজিয়েছেন। বাড়ির সামনে একটি ফলক লাগিয়েছেন যেখানে লেখা আছে – “এমিলির বাড়ি”। প্রতি বছর এমিলির জন্মদিনে তারা একটি অনুষ্ঠান করেন, যেখানে স্থানীয় লোকজন আসেন, গান হয়, গল্প হয়।
অনন্যা এখন কলেজে পড়ে। সে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছে। তার স্বপ্ন, একদিন সে এমিলির মতো অনেক হারিয়ে যাওয়া গল্প খুঁজে বের করবে, যাতে কোনো আত্মা অশান্ত না থাকে।
এরপর কার্শিয়াংয়ের সেই পুরনো বাংলো বাড়িটি এখন একটি নতুন পরিচয় পেয়েছে। অনিমেষ ও মধুমিতা এটিকে একটি ছোট্ট সংগ্রহশালায় পরিণত করেছেন, যেখানে এমিলির জীবনের স্মৃতি এবং সেই সময়ের ইতিহাস সংরক্ষিত আছে। বহু লোক আসে এখন এই সংগ্রহশালায়। এতো লোকের সমাগম দেখে অনন্যা উৎসাহের সাথে বলল,
-“দেখো, কত লোক আসছে এমিলির গল্প শুনতে! আমরা সত্যিই কিছু ভালো করতে পেরেছি।”
অনিমেষ গর্বের সাথে বললেন,
-“হ্যাঁ মা, তুমি ঠিক বলেছ। আমরা শুধু একটা বাড়ি কিনিনি, একটা ইতিহাস বাঁচিয়েছি।”
মধুমিতা যোগ করলেন,
-“আর তোমার জীবনেও একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। তোমার গবেষণা দেখে আমরা খুব গর্বিত।”
অনন্যা কলেজ থেকে ফিরে এসে এই প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছে। সে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে পুরনো গল্প সংগ্রহ করে, ছবি জোগাড় করে, এবং সেগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখে।
ধীরে ধীরে এই বাড়িটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। লোকেরা আসে এমিলির গল্প শুনতে, পুরনো বাংলো বাড়ির ঐতিহ্য দেখতে। অনন্যা প্রায়ই পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করে, তাদের কাছে এমিলির গল্প বলে।
একদিন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন বাড়ি দেখতে। তিনি অনন্যার কাছে এমিলির গল্প শুনে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। পরে জানা গেল, তিনি এমিলির সেই ভারতীয় প্রেমিকের ছেলে। তার বাবা সারাজীবন এমিলিকে ভুলতে পারেননি।
এই ঘটনার পর অনন্যা আরও উৎসাহী হয়ে উঠলো। সে ঠিক করলো, শুধু এমিলির নয়, এই অঞ্চলের আরও অনেক হারিয়ে যাওয়া গল্প খুঁজে বের করবে। সে স্থানীয় প্রবীণদের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করলো, পুরনো দলিলপত্র খুঁজতে লাগলো।
অনিমেষ ও মধুমিতা দেখলেন, তাদের মেয়ে যেন নতুন করে জীবন পেয়েছে। যে মেয়ে একসময় ভূতের ভয়ে কাঁপতো, সেই মেয়ে এখন ইতিহাসের গভীরে ডুব দিচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া গল্প খুঁজে বের করছে।
এভাবে বছর কেটে গেল। অনন্যা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছে, বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলে ভারত-ব্রিটিশ সম্পর্কের ওপর। তার গবেষণার বিষয় হলো কার্শিয়াংয়ের চা বাগানের ইতিহাস এবং সেখানে ভারতীয় ও ব্রিটিশদের মধ্যে সম্পর্ক।
অনন্যার গবেষণা পড়ে অনেক ঐতিহাসিক মুগ্ধ হয়েছেন। তার লেখা একটি প্রবন্ধ একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে অনিমেষ ও মধুমিতার বাড়িটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ যাদুঘরে পরিণত হয়েছে। এখানে শুধু এমিলির গল্প নয়, কার্শিয়াংয়ের সামগ্রিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এখানে এসে ইতিহাস শেখে।
আর সেই পুরনো কূয়াটি? সেটি এখন সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। তার চারপাশে ফুলের বাগান করা হয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে একটি ছোট্ট প্রদীপ জ্বালানো হয় এমিলির স্মৃতিতে।
মাঝে মাঝে রাতে এখনও সেই মিষ্টি গানের সুর ভেসে আসে। কিন্তু এখন আর কেউ ভয় পায় না। বরং মনে হয়, এমিলি যেন খুশি হয়ে গান গাইছে, কারণ তার গল্প আজ সবাই জানে, সবাই মনে রাখে।
অনন্যা জানে, তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এই ঘটনা। একটি ভূতের গল্প তাকে ইতিহাসের গভীরে নিয়ে গেছে। সে এখন বুঝতে পারে, প্রতিটি জীবনের পেছনে একটি গল্প থাকে, আর সেই গল্প শোনা ও বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এভাবেই কার্শিয়াংয়ের সেই পুরনো বাংলো বাড়িটি, যা একসময় ভূতুড়ে বলে পরিচিত ছিল, আজ হয়ে উঠেছে জ্ঞান ও ইতিহাসের এক অমূল্য ভাণ্ডার। আর অনিমেষ, মধুমিতা ও অনন্যা – এই তিনজন মানুষের জীবনও পালটে গেছে। তারা শিখেছেন, ভয় পাওয়ার চেয়ে বোঝার চেষ্টা করা, লুকিয়ে রাখার বদলে গল্প বলা – এটাই জীবনের সত্যিকারের পথ।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Olivia Das |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Narrator | Souradip Roy |
Characters | Name |
---|---|
Ananya | Olivia |
Animesh | Joydeep Lahiri |
Madhumita | Priyanka Dutta |
Emily | Olivia |
Ojha- | Debanshu Ghosh |
Find us on Facebook – click here