রাঙা মামা

Views: 0
রাঙা মামা:
গত দু মাস রাঙা মামার কোনো চিঠি পাইনি। রাঙা মামা গ্রামে থাকেন ও একটা স্কুলে পড়ান। রাঙা মামা প্রতি মাসে আমাকে একটা করে চিঠি আর একটা করে নতুন বই পাঠান। এই অভ্যাস টা অনেকদিন এর। এখন আমি কলকাতায় চাকরি করি। এখনও এই প্রথা চালু আছে। গত দু মাস চিঠি না পাওয়াতে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। কি জানি শরীর খারাপ হল কিনা। একটা মোবাইলও, মামা, নিজের কাছে রাখে না, যে ফোন করে খবর নেবো। এইসব ভাবতে ভাবতে দিন কেটে যায়। সেদিন দুপুরে বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিলাম। বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি একজন পিওন এসেছে। তাড়াতাড়ি সই করে চিঠি টা নিলাম। মন টা খুশি তে ভরে গেলো। পিওন চলে যেতে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলাম। অবাক হলাম এটা দেখে যে মামা এবারে কোনো বই পাঠায় নি। তাই কিছুটা বিষন্ন হয়ে চিঠি টা খুলে পড়তে শুরু করলাম:
স্নেহের বুড়ো,
গত দু মাস কাজের চাপ থাকায় তোকে চিঠি লিখতে পারি নি। আশা করি তুই ভালোই আছিস। এবারে বই পাঠাতে পারলাম না তার জন্য দুঃখিত। অনেকদিন তোকে দেখিনি। এখন শীতের ছুটি চলছে। সময় পেলে চলে আসিস। তোর সাথে অনেক দরকারী কথা আছে। ভালো থাকিস। আমার আশীর্বাদ নিস।
ইতি
তোর রাঙা মামা।
চিঠি টা পড়ে বুঝলাম মামার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। মামার চিঠি কোনোদিন এত ছোটো হয় না। তাই আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম রাঙা মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
গণ্ডগোল টা বাঁধলো বিকালে। প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি এসে গিয়ে আরো আধ ঘন্টা দেরি হয়ে গেলো। কোনো রিক্সা বা ভ্যান কিছুই এদিকে আসতে চায় না। আর আসবেই বা কি করে? পথ ঘাটের যা অবস্থা হয়েছে, জল জমে তো রাস্তা পুরো পুকুর হয়ে গেছে। এদিকে খুব একটা আলো নেই। দোকানপাটও বন্ধ। শীতের রাত। কেউ যে বাইরে থাকবে এটা আশা করাটাই বোকামি। আমি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মামার বাড়ি পৌঁছলাম। সদর দরজা তে টোকা দিতে গিয়ে দেখলাম দরজা খোলা। আমি দরজা দিয়ে ঢুকে বারান্দায় উঠে দেখি বসার ঘরে আলো জ্বলছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দেখি ডক্টর দত্ত একটা বই পড়ছেন। ডক্টর দত্ত মামার ভালো বন্ধু জানতাম কিন্তু ওনাকে এখানে এখন দেখতে পাব আশা করিনি। উনি আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে মুখ তুলে তাকালেন। আফসোসের সুরে বললেন,” এত দেরি করলে কেনো প্রশান্ত?” আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি তো কাল চিঠি পেয়ে আজ চলে এসেছি। তাহলে দেরি হলো কখন? উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” দুদিন আগে তোমার রাঙা মামা কলেরায় মারা গেছেন। তোমার ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। পোস্ট অফিস গেছিলাম গতকাল। জানতে পারলাম ডাক ব্যবস্থার গোলযোগের কারণে অনেক চিঠি শহরে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়েছে। আমি তোমার আসার জন্যে এখানে অপেক্ষা করছিলাম। আমাকে নবীন বলেছিলো যে তুমি আসবে। ও না থাকলেও আমি যেনো তোমার জন্য থাকি। তুমি এখন এসে গেছ। তোমার জন্য তোমার মামা যা রেখে গেছেন তা আমি তোমাকে কাল সকালে এসে বুঝিয়ে দেবো। তোমার শোবার ব্যবস্থা তোমার মামার ঘরেই করা হয়েছে। রান্নাঘরে খাবার রাখা আছে। খেয়ে নিও। আমি আসি।” আমি গভীর বিস্ময়ে কথা গুলো শুধু শুনে গেলাম। তারপর শুধু বললাম,” ডাক্তার মামা, আপনি কিছু করতে পারলেন না?” উনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন,” চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি। সদর হাসপাতালে ও নিয়ে গেছিলাম। তাও কিছু হল না।” উনি আর দাঁড়ালেন না। আমিও কিছু না বলে বসে রইলাম অনেকক্ষন।
রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে মামার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। মনটা ভালো নেই একদম। মামার এই হঠাৎ চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। ঘুম আসছিল না। জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন সকালে ডাক্তার কাকা আবার এলো। আমি তখন বাগানে পায়চারি করছি। কানাই কাকা এই বাড়ির অনেকদিনের পুরোনো চাকর। মামা কে খুব ভালোবাসত। কাল রাতে বাড়ি গিয়েছিল। আজকে সকালে এসে আমাকে দেখে প্রথমেই কান্নায় ভেঙে পড়লো। তারপর অনেক কষ্ট করে তাকে শান্ত করা গেছে। তার বানানো গরম চা নিয়ে আমি বাগানে একটা গাছ দেখছিলাম, তখন ডাক্তার কাকা ডাকল। ” প্রশান্ত, এই ডায়েরি টা রাখো। নবীন রেখে গিয়েছে তোমার জন্য।” আমি পিছন ফিরে ডায়েরি টা নিলাম। খুলতে যাচ্ছিলাম সেটা, উনি বাধা দিয়ে বললেন,” এখন থাক। তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। সেগুলো সেরে নিই।” আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তারপর দুজনে বারান্দায় দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসলাম। ডাক্তার মামা একটা ফাইল থেকে কিছু কাগজ বার করে বললেন,” নবীন তোমার নামে তার সব কিছু উইল করে দিয়ে গেছে। আমাকে বলেছিলো আমি যেন তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিই। তুমি কাগজ গুলো দেখে রেখো। আমি সন্ধ্যায় আবার আসব। এখন একটু শহরে যেতে হবে। আসি।” ডাক্তার মামা কে আমি বললাম,” দেখার কি আছে? মামা যখন নেই তার আর কিছুতে আমার আর মন নেই। আপনি আসুন সন্ধ্যায়। আপনার সাথে এই ব্যাপারে কিছু আলোচনা করার আছে।” ডাক্তার মামা মাথা নেড়ে চলে গেলেন।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে আমি বসার ঘরে ডায়েরি টা নিয়ে বসলাম। মামা ডায়েরি লিখত সেটা আমি জানতাম না। ডায়েরি তে মানুষ তার ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা লেখে। সেটা পড়া নিতান্তই একটা বাজে প্রবৃত্তি। কিন্তু মামা যেহেতু এটা আমার জন্যে রেখে গেছে তাই পড়ে একবার দেখা যেতে পারে। ডায়েরি টা খুললাম। লেখা রয়েছে:
২৬/১২/ ২০০৫, রাত ৯ টা।
আমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ডাক্তার সন্দেহ করছে যে আমার কলেরা হয়েছে। দিন দিন উপসর্গ গুলো বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। বুড়ো তোর সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা জানিনা। তাই তোর জন্য কিছু কথা আমি এই ডায়েরি তে লিখে রেখে যাচ্ছি। শুনেছি কিছু গণ্ডগোল চলছে ডাক ব্যবস্থার তাই চিঠি তুই কবে পাবি তাও জানি না। বুড়ো, তুই আমাকে এটার জন্য কোনদিন ক্ষমা করবি কিনা আমি তাও জানিনা। তবে তোকে আজ সব সত্যি বলে যেতে চাই। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে আমি এখানে আসি। তোর মাও ছিল আমার সাথে। চাকরিতে বদলি হয়েছিলো আমার। এখানে আসার তিন মাস পর তুই হস। তোর মায়ের শরীরে কিছু সমস্যা ছিল। ডাক্তার চিকিৎসা করেছিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা করা যায়নি। তোর চার মাসের মাথায় তোর মা চলে যায়। আমি তখন তোকে নিয়ে একা। কি করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তোর মায়ের চলে যাওয়া টা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়েই আবার বদলির জন্য চিঠি লিখলাম। কিন্তু তোকে নিয়ে এভাবে এদিক ওদিক করা আমার অসুবিধা সৃষ্টি করেছিলো। তখন ডেকে পাঠালাম আমার এক বিশ্বস্ত বন্ধু প্রবীর কে। যাকে তুই বাবা বলে জেনে এসেছিস। প্রবীর আর তার স্ত্রী নিঃসন্তান ছিল। তাদের মনে এই জন্য অনেক আফসোস ছিল। তারা এসে সব কিছু শুনে এক কথায় তোকে দত্তক নিতে রাজি হয়ে যায়। আমিও তখন তোর মায়ের মৃত্যু শোক কে বুকে নিয়ে সেখান থেকে দূরে চলে যাবার জন্য তোকে স্বার্থপরের মত ওদের দিয়ে দিলাম। ওরাই তোকে পুত্র স্নেহে বড় করেছে। মানুষের মত মানুষ করেছে। তুই এত কিছু জেনে হয় তো এটা ভাবতে পারিস যে তোর বাবার কথা কেনো আমি একবারও উল্লেখ করিনি। করার কোনো উপায় নেই। সেই মানুষ নিজের দিকটা আগে দেখে তোকে সারাজীবনের জন্য বাবার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে। আজ তোকে সেটা জানাতে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে সেই মানুষটা আমি।”
এতটুকু পড়ে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। যাকে ছোট্ট থেকে রাঙা মামা বলে জেনে এলাম সেই মানুষ টা আমার বাবা। বাবার মতই তিনি আমাকে সবসময় আগলে রেখেছিলেন। এই জন্য উনি প্রতি বছর জন্মদিনে আমার সাথে দেখা করতে আসতেন আর প্রতি মাসে ২০০০ টাকা করে আমাকে মানি অর্ডার পাঠাতেন। মাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি যে কেন উনি এটা করেন। মা শুধু বলত যে আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে বলে। এখন সব বুঝতে পারছি। চোখের কোণে জল চিক চিক করছিলো আমার। তখন নিজেই নিজেকে দোষ দিচ্ছিলাম কেন আমি আসতে পারিনি একবারও। যে মানুষটা আমার জন্য এত কিছু করলো তার প্রতিদানে তার সাথে শেষ দেখাটা ও করতে পারলাম না আমি। অপরাধীর মত বাকিটা আবার পড়তে শুরু করলাম
” তুই আমার নিজের সন্তান। তাই তোকে যাতে কোনোভাবে দূর থেকে হলেও নিজের সাথে জড়িয়ে রাখতে পারি তাই তোকে শিখিয়েছিলাম আমাকে রাঙা মামা বলে ডাকতে। আমি তোর জন্য সেভাবে কিছু করতে পারিনি। কিন্তু জীবনের শেষ বেলায় এসে বাবার একটা কর্তব্য করেছি। আমার সারা জীবনের সব উপার্জন আর সম্পত্তি তোর নামে করে দিয়েছি। ডাক্তারের কাছে সব আছে। একটা আফসোস থেকে গেলো এই যে তোকে শেষ সময়ে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করার মত সুখ পেলাম না। একজন হতভাগ্য বাবা আমি। আজ তোকে সবকিছু জানিয়ে আমি অনেকটা স্বস্তি পেলাম। তুই ভাল থাকিস বুড়ো। আমার আশীর্বাদ তোর সাথে সারাজীবন সবসময় থাকবে। জীবনে আরও উন্নতি করিস। God bless you, my son. God bless you.”ডায়েরি পড়া শেষ করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। জীবনের সব থেকে বড় সত্যি জেনে নিজেকে নিজেই সামলাতে পারছিলাম না। উইলের কাগজ গুলো টেবিলের ওপর পড়েছিল। সেগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে সোজা ঘরে চলে গেলাম ডায়েরি টা নিয়ে। দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিলাম অনেকক্ষন। পরেরদিন ডাক্তার মামার সাথে কথা বলে সব সম্পত্তি একটা অনাথ আশ্রমে দিয়ে দি। নিজের আসল জন্মদাতার জন্য জীবনে প্রথমবার ছেলে হয়ে তার শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করেছিলাম। কর্তব্য শেষ করে সেখানে আর থাকিনি। সত্যিকারের স্নেহ আর সুরক্ষার ছাতা যখন মাথার ওপর থেকে সরে গেছে সেখানে কতগুলো কাগজ আমাকে ভবিষ্যতের কি সুরক্ষা দেবে? কানাই কাকার হাতে সব দায়িত্ব দিয়ে চলে আসি। আসার সময়ে যেন মনে হল পেছন থেকে বাবা বলছে,” ভালো থাকিস, বুড়ো। ভালো থাকিস।”
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Trisha Laha |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Debanshu Ghosh |
Characters | Name |
---|---|
Ranga Mama | Suman Sadhukha |
Dr. Kaka | Joydeep Lahiri |
Find us on Facebook – click here