স্বাধীনতার সূর্যোদয়
Views: 0
স্বাধীনতার সূর্যোদয়:
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কলকাতার রাজপথে জনতার ঢল নেমেছে। হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে “বন্দে মাতরম”। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই ভারত স্বাধীন হবে। দুশো বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে পড়বে।
সেই উত্তাল জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল অমল। বয়স মাত্র আঠারো। কিন্তু চোখে তার অসীম স্বপ্ন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার স্বপ্ন। তার পাশেই ছিল বাবা সুধীর বাবু। স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।
অমল বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, আমরা কি সত্যিই স্বাধীন হতে চলেছি?”
সুধীর বাবু ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, “হ্যাঁ বাবা, আমরা স্বাধীন হতে চলেছি। কিন্তু মনে রাখবে, স্বাধীনতা শুধু অধিকার নয়, দায়িত্বও বটে।”
অমল বাবার কথা শুনে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে জানতে চাইল, “কী রকম দায়িত্ব বাবা?”
সুধীর বাবু বললেন, “দেখো বাবা, আমরা যে স্বাধীনতা পেতে চলেছি, তার জন্য অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব হল সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।”
অমল মাথা নেড়ে সায় দিল। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগল, কীভাবে সে এই দায়িত্ব পালন করবে?
ঠিক তখনই দূরে ঘড়িতে বারোটা বাজল। চারদিকে উল্লাসের ঢেউ উঠল। ভারত স্বাধীন হয়েছে। অমল আর সুধীর বাবু দুজনেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। চোখে তাদের আনন্দাশ্রু।
পরের দিন সকালে অমল ঘুম থেকে উঠে দেখল, তাদের পাড়ায় উৎসবের মেজাজ। সবাই মিষ্টি বিলি করছে, একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। কিন্তু অমলের মনে তখনও কালকের প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে কীভাবে দেশের জন্য কিছু করবে?
সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এল শহরের প্রান্তে। সেখানে একটা বস্তি। দারিদ্র্যের করাল ছায়া সেখানে। অমল দেখল, কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়ে রাস্তার ধারে বসে আছে। তাদের চোখেমুখে আনন্দের ছোঁয়া নেই।
অমল তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে কেন বসে আছ? স্কুলে যাও না?”
একটি ছোট্ট মেয়ে বলল, “দাদা, আমরা স্কুলে যেতে পারি না। আমাদের বাবা-মা বলে, স্কুলের খরচ চালাতে পারবে না।”
অমলের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। তার মনে হল, এই তো সেই সুযোগ যার জন্য সে অপেক্ষা করছিল। সে ঠিক করল, এই শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করবে।
বাড়ি ফিরে অমল বাবাকে তার পরিকল্পনার কথা বলল। সুধীর বাবু গর্বের সঙ্গে ছেলের পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, “বাবা, তুমি ঠিক পথেই হাঁটছ। শিক্ষাই পারে একটা জাতিকে শক্তিশালী করতে।”
পরের দিন থেকেই অমল কাজে নেমে পড়ল। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলল। তারা সবাই মিলে একটা ছোট্ট স্কুল শুরু করল বস্তির পাশে। প্রথমে মাত্র দশজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হল স্কুল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বেড়ে চলল।
মাস ছয়েক পর। অমলের স্কুলে তখন প্রায় পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী। সবাই খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। অমল আর তার বন্ধুরা পালা করে পড়াচ্ছে তাদের।
একদিন সকালে অমল স্কুলে এসে দেখল, একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি স্থানীয় বিধায়ক। অমলের কাজের খবর পেয়ে তিনি দেখতে এসেছেন।
বিধায়ক মহাশয় অমলের পিঠ চাপড়ে বললেন, “বাবা, তুমি যে কাজ শুরু করেছ, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তোমার মতো তরুণরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
অমলের চোখ ছলছল করে উঠল। সে বুঝতে পারল, সে সত্যিই দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছে।
কিন্তু এই সাফল্যের পরও অমল থেমে থাকেনি। সে আরও বেশি করে কাজ করতে লাগল। শুধু পড়াশোনা নয়, সে ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও সচেতন করতে চাইল।
সে স্থানীয় একজন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করল। ডাক্তার সাহেব খুশি হয়ে রাজি হলেন প্রতি সপ্তাহে একবার করে স্কুলে আসতে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন, তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন।
এভাবেই দিন যেতে লাগল। অমলের স্কুল ক্রমশ বড় হতে লাগল। এখন সেখানে প্রায় দুশো ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। শুধু তাই নয়, অনেক ছাত্রছাত্রী এখন উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রস্তুত।
একদিন সকালে অমল স্কুলে এসে দেখল, তার প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা সবাই জমায়েত হয়েছে। তাদের মধ্যে রতন, যে এখন একটি ভাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। সুমি, যে একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করছে। আর রহিম, যে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছে।
তারা সবাই অমলকে ঘিরে ধরল। রতন বলল, “দাদা, আপনি না থাকলে আমরা কেউই এতদূর আসতে পারতাম না। আপনি আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন।”
সুমি চোখ মুছতে মুছতে বলল, “দাদা, আমি যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম, তখন ভাবতেই পারিনি যে একদিন আমি একজন নার্স হতে পারব। আপনার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।”
রহিম বলল, “দাদা, আপনি শুধু আমাদের পড়াশোনা শেখাননি, আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন যে আমরাও কিছু করতে পারি।”
অমলের চোখ ছলছল করে উঠল। সে বুঝতে পারল, তার ছোট্ট প্রয়াস কত বড় পরিবর্তন এনেছে এই মানুষগুলোর জীবনে।
সেদিন সন্ধ্যায় অমল বাড়ি ফিরে এল। বাবা সুধীর বাবু বারান্দায় বসেছিলেন। অমল গিয়ে বাবার পাশে বসল।
সুধীর বাবু ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী রে, আজ তোর মুখ এত উজ্জ্বল কেন?”
অমল বাবাকে সব কথা বলল। তারপর বলল, “বাবা, মনে আছে, স্বাধীনতার দিন তুমি বলেছিলে স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বও আসে? আজ আমি বুঝতে পারছি, সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি কিনা।”
সুধীর বাবু ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “হ্যাঁ বাবা, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। তুমি যা করেছ, তা-ই হল প্রকৃত দেশপ্রেম। দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু বক্তৃতা দেওয়া নয়, দেশের মানুষের জন্য কিছু করা।”
অমল বাবার কথা শুনে আরও উৎসাহিত হল। সে ঠিক করল, এখন সে আরও বেশি করে কাজ করবে। শুধু শিক্ষা নয়, সে এবার গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য কাজ করবে।
পরের দিন সকালে অমল তার বন্ধুদের ডাকল। তাদের সামনে তার নতুন পরিকল্পনা তুলে ধরল।
সবাই উৎসাহের সঙ্গে সায় দিল অমলের প্রস্তাবে। তারা ঠিক করল, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াবে।
অমল আর তার দল প্রথমে গ্রামের মোড়লের কাছে গেল। মোড়ল মশাই প্রথমে একটু সন্দেহের চোখে তাকালেন। কিন্তু অমলের কথা শুনে তিনি খুশি হলেন। বললেন, “বাবা, তোমরা যে কাজ করতে চাইছ, তা খুবই ভালো। আমি তোমাদের সব রকম সাহায্য করব।”
মোড়ল মশাইয়ের সমর্থন পেয়ে অমলরা আরও উৎসাহিত হল। তারা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে লাগল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব, সুষম খাবারের প্রয়োজনীয়তা, টিকা নেওয়ার প্রয়োজন – এসব বিষয়ে তারা মানুষকে বোঝাতে লাগল।
প্রথম দিকে অনেকেই তাদের কথা শুনতে চাইল না। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারল যে এই ছেলেরা তাদের ভালোর জন্যই এসেছে।
মাস দুয়েক পর। গ্রামের চেহারা বদলে যেতে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার হয়েছে। লোকজন নিয়মিত হাত ধুচ্ছে। শিশুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে।
একদিন সকালে অমল দেখল, গ্রামের একজন বৃদ্ধ তার দিকে এগিয়ে আসছেন। বৃদ্ধ এসে অমলকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “বাবা, তোমরা যে কাজ করছ, তার জন্য ধন্যবাদ। আমার নাতি গত মাসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তোমাদের দেওয়া পরামর্শ মেনে চলায় সে এখন সুস্থ।”
অমলের চোখ ছলছল করে উঠল। সে বুঝতে পারল, তার ছোট্ট প্রয়াস কতটা বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
এরপর থেকে অমল আরও বেশি উদ্যমে কাজ করতে লাগল। সে শুধু নিজের গ্রামেই সীমাবদ্ধ থাকল না। আশপাশের গ্রামগুলোতেও যেতে লাগল। তার বন্ধুরাও তার সঙ্গে যোগ দিল।
ধীরে ধীরে তাদের কাজের খবর ছড়িয়ে পড়ল। একদিন জেলা প্রশাসক এসে হাজির হলেন গ্রামে। তিনি অমলের কাজ দেখে মুগ্ধ হলেন। বললেন, “বাবা, তোমরা যে কাজ করছ, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি চাই, তোমরা পুরো জেলায় এই কাজ ছড়িয়ে দাও।”
অমল প্রথমে একটু ভয় পেল। এত বড় দায়িত্ব সে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু তার বন্ধুরা তাকে উৎসাহ দিল। বলল, “আমরা সবাই আছি তোর সঙ্গে। আমরা মিলে এই কাজ করব।”
অমল রাজি হল। জেলা প্রশাসকের সহায়তায় তারা পুরো জেলায় তাদের কাজ ছড়িয়ে দিল। প্রতিটি গ্রামে তারা স্বাস্থ্য শিবির করল। মানুষকে সচেতন করল।
এভাবে বছর দুয়েক কেটে গেল। অমল এখন আর সেই আঠারো বছরের কিশোর নেই। সে এখন একজন পরিণত যুবক। তার চোখে এখন আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।
একদিন সকালে অমল খবরের কাগজ পড়ছিল। হঠাৎ একটা খবর দেখে তার চোখ কপালে উঠল। খবরটা ছিল তার নিজের সম্পর্কে। লেখা ছিল, গ্রাম উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের জন্য যুব পুরস্কার পাচ্ছেন অমল।
অমল বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে ছুটে গেল বাবার কাছে। বাবাকে খবরটা দেখাল।
সুধীর বাবু ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “বাবা, আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত। তুমি প্রমাণ করেছ যে দেশপ্রেম শুধু কথার কথা নয়, কাজেও দেখাতে হয়।”
অমল বলল, “বাবা, এটা শুধু আমার একার কাজ নয়। আমার বন্ধুরা, গ্রামের মানুষ – সবাই মিলে এটা সম্ভব হয়েছে।”
সুধীর বাবু বললেন, “ঠিক তাই বাবা। দেশ গড়া মানেই হল সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তুমি সেটাই করেছ।”
পুরস্কার গ্রহণের দিন। রাজধানীর একটি বড় হলঘরে অনুষ্ঠান। দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এসেছেন পুরস্কার দিতে।
অমল যখন মঞ্চে উঠল, হলঘর ভর্তি মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিতে লাগল। প্রধানমন্ত্রী তাকে পুরস্কার দিয়ে বললেন, “আপনি যে কাজ করেছেন, তা আমাদের সবার কাছে অনুপ্রেরণা। আপনার মতো মানুষরাই আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
অমল মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এই পুরস্কার গ্রহণ করছি আমার সহকর্মী, বন্ধু এবং গ্রামের মানুষদের পক্ষ থেকে। আমরা সবাই মিলে যে কাজ করেছি, তার স্বীকৃতি এই পুরস্কার। আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক নাগরিকের ছোট ছোট প্রচেষ্টা মিলেই একটা দেশ এগিয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে যদি নিজের নিজের জায়গা থেকে দেশের জন্য কিছু করি, তাহলে আমাদের দেশ অবশ্যই বিশ্বের সেরা দেশগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠবে।”
অমলের কথা শেষ হতেই হলঘর ফেটে পড়ল করতালিতে। সবার চোখে তখন স্বপ্নের ঝিলিক।
সেদিন রাতে অমল যখন হোটেল রুমে ফিরল, সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশে তখন অসংখ্য তারা। অমলের মনে হল, প্রত্যেকটা তারা যেন একেকজন দেশপ্রেমিক । যারা নিজের জায়গা থেকে দেশের জন্য কিছু করছে।
সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “এই যে আমি শুরু করলাম, এটা কি শেষ? না, এটা তো শুরু। এখনও অনেক কাজ বাকি। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।”
অমল দৃঢ় সংকল্প নিল, সে আরও কঠোর পরিশ্রম করবে। শুধু নিজের জেলা নয়, পুরো দেশজুড়ে সে এই কাজ ছড়িয়ে দেবে। সে জানে, এটা সহজ হবে না। অনেক বাধা আসবে। কিন্তু সে হার মানবে না। কারণ তার হৃদয়ে জ্বলছে দেশপ্রেমের অগ্নিশিখা।
পরের দিন সকালে অমল যখন ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিল, তার মনে হল যেন দেশের প্রতিটি মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে অনেক প্রত্যাশা। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে সেই প্রত্যাশা পূরণ করবে।
ট্রেন যখন তার গ্রামের কাছাকাছি এল, অমল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। দূরে দেখা যাচ্ছিল তার গ্রামের সবুজ ক্ষেত। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে ধানের শীষ। অমলের মনে হল, এই যে সোনালি ধানের শীষ, এটাই যেন তার দেশের ভবিষ্যৎ। উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ।
সে নিজেকে বলল, “হ্যাঁ, আমি পারব। আমরা সবাই মিলে পারব। আমাদের দেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক গর্বের সঙ্গে বলতে পারবে – আমি এই দেশের সন্তান।”
ট্রেন যখন স্টেশনে এসে থামল, অমল দেখল প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য মানুষ। তারা সবাই এসেছে তাকে অভিনন্দন জানাতে। অমলের চোখ ছলছল করে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই মানুষগুলোর জন্যই তার লড়াই। এই মানুষগুলোর জন্যই তার স্বপ্ন।
সে ট্রেন থেকে নেমে এল। চারদিক থেকে শোনা গেল “বন্দে মাতরম”। অমলের মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা। স্বাধীনতার আগের রাত | যেদিন সে বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল রাজপথে।
আজ সে বুঝতে পারছে, স্বাধীনতা শুধু একটা দিন নয়, একটা প্রক্রিয়া। যা প্রতিদিন নতুন করে অর্জন করতে হয়। প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্যপালনের মধ্য দিয়ে।
অমল ভিড়ের মধ্য থেকে বাবাকে খুঁজে পেল। সুধীর বাবুর চোখে তখন গর্বের আভা। তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের মোড়ে একটা ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। গ্রামের সবাই এসেছে। অমল মঞ্চে উঠে বলল, “আপনারা সবাই আমাকে যে সম্মান দেখিয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি মনে করি, এই সম্মান শুধু আমার নয়, আমাদের সবার। কারণ আমরা সবাই মিলে এই পরিবর্তন এনেছি।”
তারপর সে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবার সামনে তুলে ধরল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি – সব ক্ষেত্রেই কীভাবে আরও উন্নতি করা যায়, সে সম্পর্কে সে তার ভাবনা শেয়ার করল।
গ্রামের একজন বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বাবা অমল, তুমি যে পথ দেখিয়েছ, আমরা সবাই সেই পথে হাঁটব। তোমার সঙ্গে আছি আমরা।”
সেই মুহূর্তে অমল অনুভব করল, এটাই প্রকৃত স্বাধীনতা। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। যেখানে সবাই মিলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।
পরের দিন সকালে অমল তার পুরনো স্কুলে গেল। যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাকে ঘিরে ধরল।
একটি ছোট্ট মেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, আমিও কি একদিন আপনার মতো হতে পারব?”
অমল মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলল, “তুমি আমার চেয়েও বড় কিছু করতে পারবে। তোমার মধ্যে যে স্বপ্ন আছে, সেটাকে বড় করে দেখো। দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন।”
সেদিন সন্ধ্যায় অমল বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েছিল। আকাশে তখন সন্ধ্যা তারা ফুটেছে। দূরে দেখা যাচ্ছিল গ্রামের আলোগুলো।
হঠাৎ তার মনে হল, প্রতিটি আলো যেন একেকটা স্বপ্ন। যে স্বপ্ন দেখছে এই দেশের মানুষ। স্বাধীন, সমৃদ্ধ, উন্নত দেশের স্বপ্ন।
অমল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে জীবন দিয়ে হলেও সেই স্বপ্ন পূরণ করবে। কারণ তার কাছে দেশপ্রেম শুধু একটা শব্দ নয়, একটা অনুভূতি। যা তার রক্তের প্রতিটি কণায় প্রবাহিত হয়।
সে জানে, পথ সহজ হবে না। অনেক বাধা আসবে। কিন্তু সে হার মানবে না। কারণ তার পাশে আছে তার দেশের মানুষ। যারা তার সঙ্গে স্বপ্ন দেখে। যারা তার সঙ্গে লড়াই করে।
অমল আকاশের দিকে তাকিয়ে বলল, “হে মা ভারতী, তোমার চরণে আমার প্রণাম। আমি প্রতিজ্ঞा করছি, যতদিন দেহে প্রাণ আছে, ততদিন তোমার সেবা করব। তোমাকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাব।”
সেই মুহূর্তে একটা মৃদু বাতাস বয়ে গেল। অমলের মনে হল, যেন মা ভারতী তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন।
অমল জানে, তার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি, বরং শুরু হয়েছে। এই যাত্রাপথে অনেক চড়াই-উৎরাই আসবে। কিন্তু সে ভয় পায় না। কারণ তার হৃদয়ে জ্বলছে দেশপ্রেমের অনির্বাণ শিখা।
সে দৃঢ় সংকল্প নিল, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে নতুন করে প্রতিজ্ঞা করবে। দেশের জন্য কিছু করার প্রতিজ্ঞা। ছোট হোক বা বড়, কোনো কাজই ছোট নয় যদি তা দেশের জন্য করা হয়।
অমল জানে, একা সে হয়তো পুরো দেশ বदলে দিতে পারবে না। কিন্তু সে যদি একজন মানুষের জীবনও বদলে দিতে পারে, তাহলেও তার প্রচেষ্টা সার্থক।
সেই রাতে অমল স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে দেখল, তার দেশ বিশ্বের সেরা দেশগুলোর মধ্যে একটি। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক সুখে, শান্তিতে বসবাস করছে। যেখানে কেউ অভুক্ত, অশিক্ষিত নেই।
ভোর হতেই অমলের ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে বসল বিছানায়। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল সূর্যোদয়। নতুন দিনের সূচনা।
অমল মনে মনে বলল, “এই নতুন দিন, নতুন সূর্য আমাকে নতুন করে প্রেরণা দিক। আমার দেশকে ভালোবাসার শক্তি দিক। কারণ আমার কাছে দেশপ্রেম শুধু একটা শব্দ নয়, একটা জীবনব্রত।”
সে উঠে দাঁড়াল। আজ থেকে আবার শুরু হবে তার নতুন যাত্রা। দেশকে ভালোবাসার যাত্রা। দেশের জন্য কিছু করার যাত্রা।
কারণ সে জানে, প্রতিটি ছোট প্রচেষ্টা মিলেই একদিন বড় পরিবর্তন আসে। আর সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে একটি মহান জাতি।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Joydeep Lahiri |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Souradip Roy |
Amol | Joydeep Lahiri |
Sudhir Babu | Debanshu Ghosh |
Other Voice | Joydeep Lahiri, Debanshu Ghosh, Susmita Das Ghosh, Priyanka Dutta,Soumik Banerjee, Suman Sadhukhan, Surojit Mukherjee |
Find us on Facebook – click here