স্কুটি
Views: 0
স্কুটি:
অনিক বসু। ১৯ বছর বয়স। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বাড়িতে ঠাকুমা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা ৪ বছর আগে মারা গেছেন। আর মা – মা এই দু’মাস হল একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু অনিক মনে করে দুর্ঘটনা নয় মাকে ইচ্ছা করে কেউ মেরে ফেলেছে। কিন্তু প্রমান কই? প্রমান ছাড়া তো কেউ বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া ওদের মাথার ওপর ভগবান ছাড়া তো কেউ নেই। পয়সাও নেই। লড়বে কে, কিভাবে? তাই অনিক মনের কষ্ট, ব্যাথা সব চেপে রেখেছে। একদিন আসবেই। সে সুযোগ পাবেই। দোষীকে শাস্তি দেবেই। কিন্তু এখন চাই মায়ের স্কুটিটা | অনিকদের একটা সাইকেল রিপিয়ারিং-এর দোকান আছে। ঠাকুরদাদার পর অনিকের বাবা চালাতো। দোকানটা ওর বাবা বেশ খেটেখুটে, বড় করে ছিল। ৩/৪ জন কর্মচারী ছিল। সাইকেলের সাথে সাথে স্কুটিও সারাত ওর বাবা। অনেক স্কুটি সাইকেল আসতো সারাতে,
কত ভাঙ্গা স্কুটিও সারিয়ে নতুনের মতন করে দিতে পারতো ওর বাবা | এমনি একটা ভাঙা স্কুটি কিনে ভালো করে সারিয়ে রং করে অনিকের মাকে দিয়ে ছিল অনিকের বাবা। কারণ ওর বাবা সারদিন রাত দোকান নিয়ে ব্যস্ত। বাইরের যাবোতিও কাজ, দোকান বাজার, অনিককে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা সবই অনিকের মা করতো। তাই ওর বাবা স্কুটিটা ব্যবহার করতে দিয়েছিল। নিজেও যখন কোনো দূর জায়গায় –
তাগাদা করতে যেতো তো স্কুটিটা নিয়ে যেত। অনিখুব ভালোবাসতো স্কুটিটাকে। মায়ের কোমর জড়িয়ে যখন স্কুলে যেতো বা আসতো তখন ওর খুব মজা লাগতো, খুব আনন্দও হোতো। তারপর বাবা মারা যাবার পর। দোকানের কাজও মা করতো। দেখতে দেখতে দুটো কর্মচারী ছেড়ে চলে গেল। কাজও কমে গেল। এখন দুজন কাজ করে।
বাইরের তাগাদায় অনিকের মা’ই যেতো, দরকারী জিনিসপত্র কিনে এনে দিতে। এ হেন মানুষের শত্র“ও ছিল। পাশের পাড়ার দু’ভাই অজয়-বিজয়, মায়ের স্কুটিটার ওপর নজর।
প্রায় সময় অনিকের বাবা মারা যাবার পর থেকে অনিকের মাকে বলতো, – ‘‘কি হবে বৌদি স্কুটিটা রেখে আমাদের বিক্রি করে দাও। মোটা টাকা দেবো। তুমি মেয়ে ছেলে তোমায় এসব চালাতে মানায় না। গরীব মানুষ আবার স্কুটি চালায়।’’
অনিকের মা পূর্ণিমা কানে তুলতো না। অজয়দের বলতো – ‘‘আমায় লোকে খারাপ বলবে তো তোমাদের কী?’’
এই ভাবেই দিন কাটছিল।
হঠাৎ একদিন অজয় দোকানে এসে বলে, – ‘‘তোমাদের স্কুটিটা দেবে কিনা বলো না হলে ভেঙ্গে ফেলে দেবো একদিন। ভিক্ষারীর জাত আবার স্কুটি চালাবে।’’
রেগে অনিকের মা পূুর্ণিমা একটা কাঠারী নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল বলেছিল, – ‘‘আয় না, ভাঙ্গবী আয় দেখি, কার ঘাড়ে কত রক্ত আছে।’’
পালিয়ে ছিল অজয়রা। তারপর সপ্তাহ দুয়েক বেশ ভালই চলছিল। হঠাৎ একদিন একটা ভাঙ্গা সাইকেল এনে দুপুরে ওদের একটা কর্মচারীর কাছে সারাচ্ছিল তখন পূর্ণিমা দেখে বলে, – ‘‘কি ব্যাপার আমার দোকানে কেন?’’
অজয় বলে, – ‘‘রাগ করছো কেন বৌদি। সব দোকান বন্ধ তাই এসেছি।’’
সাইকেল সারিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন পুূর্ণিমা দেবী বলে, -” কি হলো সারানোর দাম দাও।’’
অজয় বলে, – ‘‘বিশ্বাস করো বৌদি, এখন একটা পয়সাও নেই কাল সকালে বাড়িতে যেও দাম নিয়ে দেবো। আমাদের কিছু বাকি আছে কি বলো?’’
পরের দিন সকাল দশটার সময় পুর্ণিমা দামটা চাইতে গিয়েছিল। তাড়া ছিল, এসে ছেলেকে কলেজে দিতে যাবে। তাই স্কুটি চেপেই গিয়েছিল। বাড়ির দরজার কাছে গাড়ি রেখে বাড়িতে ঢুকে দাম চাইতে গিয়েছিল। ৫/৭ মিনিটেই বেরিয়ে এসে পূর্ণিমা গাড়িতে চেপে ঘুরিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিল। ঠিক সেই সময় অজয়দের বাড়ি থেকে অজয়ের ছোট ছেলেটা ছুটে বেড়িয়ে আসে ,ব্রেক কষে গাড়ি থামাতে গিয়ে দেখে ব্রেক কাজ করছে না। সঙ্গে সঙ্গে পুূর্ণিমার স্কুটির সঙ্গে ধাক্কা লাগে ওই ছেলেটির দুজনেই ছিটকে পড়লো মাটিতে। দুজনারই মাথা ফেটে রক্তারক্তি কান্ড। অজয়দের বাড়ির সব লোক, রাস্তার পথ চলতি মানুষরা হই হই করে বলে ওঠে গেল-গেল-ধরো ধরো কিছু লোক বাচ্চাটাকে ধরে তুলল।
আর পুর্ণিমার দিকে রে-রে করে ছুটে এলো অজয়রা বলে, – ‘‘চালাকি পেয়েছো। গাড়ি চালাচ্ছো। এই গাড়ি চালাবার নমুনা। মানুষকে মেরে ফেলে। ভাং-ভাং গাড়িটাকে। ভেঙ্গে টুকরো করে দে।’’
কোনো রকমে পূর্ণিমা উঠে ছুটে গাড়ির কাছে এসে স্কুটিটাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। এলোপাথারি লোহার রড দিয়ে অজয় বিজয় স্কুটিটাকে ভেঙ্গে ফেলছে। সেই সময় লোহার রডের বাড়ি পূর্ণিমার মাথাতেও মেরেছে বিজয়। পূর্ণিমা ‘উঃ মাগো’ বলে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল।
অজয় বলে, – ‘‘বিজয় পালা।’’
অজয় বিজয় লাটি রড নিয়ে পালিয়ে গেল। ছোটো ছেলেটাকে ধরাধরি করে তো আগেই বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল। মিনিট দশেক পরে অনিক খাবর পায় যে তার মার এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ঘটনাস্থলে এসে দেখে ওর মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রক্তে মাটি ভিজে গেছে। আর সব ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোয় অনিক, তাও বেশ দেরী হয়ে গেছে। দশমিনিট পর ডাক্তার এল। সরকারী হাসপাতাল হলে যা হয়, ডাক্তার বাবু পরীক্ষা করে বললেন যে, অনেক দেরী হয়ে গেছে। অত্যাধিক রক্তক্ষরণে পূর্ণিমা মারা গেছে। হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে অনিক। জগতে তার কেউ রইল না…..।
এখনো অনিক কাঁদচ্ছে ঠাকুমার কোলে মাথা দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঠাকুমা বলেন, – ‘‘আর কাঁদিশ না অনি। তোর মায়ের স্কুটি ঠিক ফেরত আনতে পারবি। ওরা স্কুটিটাকে ভেঙ্গে গ্যারেজে ফেলে দিয়েছে। গ্যারজে মালিক ৫০০০ হাজারা টাকা চাইছে। এই তো। ঠিক আছে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’
– ‘‘কি করে ঠাকুমা! ঘরে খুঁজলে এখান ওখান থেকে ৫০০ টাকার বেশী আর পাবো না। আর এতো ৫০০০ হাজার টাকা।’’
হেসে ঠাকুমা বলে, – ‘‘আরে আমার বিয়ের দুটো সোনার নোয়া ছিল। একটা তোর মাকে দিয়েছি। আর একটা তোর বৌকে দেবো বলে রেখে দিয়ে ছিলাম। তা সেটাই এখন খরচ করি। পরে দেখা যাবে কি হয়।’’
হাসি ফোটে অনিকের মুখে। ঠাকুমার সোনার নোয়া বিক্রি করে ১০,০০০ হাজার টাকা পায় অনিক। ৫০০০ টাকা দিয়ে মায়ের সাধের স্কুটি গ্যারেজ থেকে নিয়ে আসে ভাঙ্গা অবস্থায়। আর ৫০০০ টাকা দিয়ে সব সরঞ্জাম নতুন কিনে এনে, স্কুটি টাকে সারিয়ে নতুন করে তোলে, নাম দেয় পূর্ণিমা।
রাত্রে পড়াশোনা করে আর দিনের বেলায় কাজ করে। আবার দোকানটা দাঁড় করাবার চেষ্টা করে। ক্রমে ক্রমে আস্তে আস্তে মাস তিনেকের মধ্যে অর্ধেক দেনা শোধ করে। হঠাৎ একদিন অজয় বিজয় দু ভাই দোকানে আসে।
– ‘‘কিরে অনিক, কেমন দোকান চলছে রে?’’ বিদ্রুপ করে বলে অজয়।
অনিক গম্ভীর গলায় বলে, – ‘‘কেন? তাতে তোমাদের কী?’’
বিজয় বলে, – ‘‘না না তেমন কিছু নয়। যদি না চালাতে পারিস তো আমরা আছি। আমাদের জানাস। যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।”
হঠাৎ অনিক শুনতে পায় স্কুটিটার গোঁ গোঁ শব্দ। চমকে দেখে, কে যেন স্কুটিতে আবছায়া মতো বসে। আকৃতিটা অনেকটা পূর্ণিমার মতন। ছুটে অনিক স্কুটিটার কাছে যায়। শব্দ থেমে যায়।
অজয় বলে, – ‘‘কিসের আওয়াজ রে।
অনিক বলে, – ‘‘ও কিছু না। তোমরা এখন যাও।’’
অজয় বিজয় চলে যায়। অনিক গিয়ে ছুটে ঠাকুমাকে জানায় সব।
ঠাকুমা শুনে বলে, – ‘‘ভয় পাস্ না ভাই। ওটা স্কুটি নয় ওই তোর মা। যত্ন করিস্ ভালবাসিস্। আর শত্রুদের থেকে দূরে রাখিস। কি জানি কখন কি হয়।’’
অনিক মনে মনে ভরসা পায় মাকে দেখে।সপ্তাহ দুয়েক পরে সন্ধ্যোবেলায় একদিন অনিক স্কুটিটা নিয়ে বেরোয়, ঠাকুমাকে বলে যে সে একটা বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে বই আনতে। বাস রাস্তার ওপারে একটা ছোট খেলার মাঠ আছে। কেউ খেলতে আসে, বেড়াতে আসে, কেউ কেউ বসে আড্ডাও মারে ,মাঠের পাশেই একটা পুকুর আছে। বেশ বড় আর গভীরও। অনেকে বসে মাছও ধরে। অনিককে মাঠ পার হয়ে বন্ধুর বাড়ি যেতে হবে । পায়ে হেঁটে ছাড়া যাবার উপায় নেই।
তাই অনিক রাস্তার ওপরে একটা দোকানে গিয়ে বলে, – ‘‘চাচা আমার স্কুটিটা লক্ করে তোমার দোকানের পাশে রেখে মাঠ পেরিয়ে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। একটু খেয়াল রেখো। আমি এখুনি আসবো।’’
চাচা বলে – ‘‘ঠিক আছে তুমি যাও। তবে তাড়াতাড়ি এসো। আমি একটু বাড়ি যাবো।’’
অনিক রাস্তা থেকে মাঠে নামে। হঠাৎ চোখে পড়ে বিজয় আর ভদ্রমহিলা পুকুর পাড়ে বসে কথা বলছে। খেয়াল না করে অনিক মাঠে নেমে যায়। এদিকে হঠাৎ স্কুটিটা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। দুপাশের সাইডের ছোট আলো জ্বলে ওঠে, যেন কে চোখ মেলে চেয়ে দেখছে। রাগে গোঁ গোঁ করে আস্তে আস্তে সিটের ওপর পূর্ণিমাকে দেখা যায় আবছায়ারূপে। বাড়িতে বউ ছেলে মেয়ে থাকতে এখানে বসে বিজয় পরস্ত্রীর সাথে পরক্রিয়া করছে। গোঁ গোঁ শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। ফট্ করে লক্ খুলে গেল। নিঃসাড়ে নিঃশব্দে গাড়িটা গড়িয়ে যায় সবার অলক্ষ্যে, আপঝা অন্ধকারে হাত পাঁচেক চলার পর জোড়ে স্প্রিড তোলে, সজোড়ে ধাক্কা মারে বিজয়কে। বিজয় ছিট্কে গিয়ে পড়ে মাঝ পুকুরে। মহিলাটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায় দেখে পিছনে একটা স্কুটি দাঁড়িয়ে। চিৎকার করে ওঠে ‘‘বাঁচাও বাঁচাও ডুবে গেল, ডুবে গেল।’’ বিজয় কিন্তু সাঁতার জানে না। চিৎকার শুনে রাস্তার ওপর থেকে পাশ থেকে লোক জন ছুটে যায় হই হই করে। মহিলাটি তখন ওদেরকে বলছে।
– ‘‘আরে একটা স্কুটি এসে সজোরে ধাক্কা মারে”| সেই ফাঁকে অনিকের স্কুটিটা নিঃশব্দে পিছু গড়িয়ে যায়। যে জায়গায় ছিল সেখানে ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে। লক্ পরে যায় ঠিকভাবে। শুনে সব চারিদিকে খোঁজে স্কুটিটাকে কিন্তু কই স্কুটি। কিছু তো নেই। দু একজন জলে ঝাঁপ দিল। যারা চেনে তারা ছুটলো বাড়িতে খবর দিতে। বাড়ি থেকে অজয় ও আরো অনেকে ছুটে এলো, পুলিশে খবর দিলো। ডুবুরী আনার জন্য।
অজয় এসে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে, – ‘‘এখানে বিজয় কি করতে এসেছিল? আর ওকে কে বা কারা ধাক্কা মারলো?’’
মহিলা চুপ। কেউ কেউ বলে, ঐ মহিলাকে দেখিয়ে দিয়ে যে উনি একটা স্কুটিকে ধাক্কা মারতে দেখেছে। পুলিশ এসেও একই প্রশ্ন করে।
তখন মহিলা রাস্তার পারে অনিকের স্কুটিটা দেখিয়ে বলে, – ‘‘এই স্কুটিটা ধাক্কা মেরেছে।’’
পুলিশ গিয়ে দেখে স্কুটি তো লক্ করা, আসার উপায় নেই। দোকানদারও তাই বলে। অবিশ্বাস্য। বিজয়ের দেহ খুঁজে পেলো। কিন্তু সে মৃত। মারা গেছে। অজয় কিছু বিশ্বাস করতে পারছে না। বিজয় মরে গেল। হঠাৎ চোখ পড়ে অনিকের স্কুটির ওপর দেখতে পায় পূর্ণিমা বসে হাসছে।
যেন বলছে- ”আমায় রড্ দিয়ে তোর ভাই মেরে ছিল। প্রতিশোধ নিলাম। “
সেই সময় অনিক আসে দেখে এই অবস্থা। অজয় ভয়ার্ত্ত চোখে স্কুটির দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে যেন ক্ষমা চাইছে।
অনিক গাড়িটা নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। বাড়িতে এসে স্কুটিটা রেখে ঠাকুমাকে ডাকলো। ঠাকুমা আসতে অনিক সব বলে।হঠাৎ দেখে স্কুটিতে পূর্ণিমা বসে। ছুটে যায় অনিক, পূর্ণিমা গাড়ি থেকে নেমে, যেন অনিকের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। গাড়িটার গায়ে হাত বুলায় তারপর আস্তে আস্তে দূরে-দূরে চলে যায় পরে বাতাসে মিলিয়ে যায়।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Kaberi Ghosh |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Debanshu Ghosh |
Characters | Name |
---|---|
Purnima Debi | Olivia Das |
Anik | Joydeep Lahiri |
Ajay | Joydeep Lahiri |
Takuma | Kaberi Ghosh |
Mohila | Susmita Das Ghosh |
Dokandar | Debanshu Ghosh |
Find us on Facebook – click here