সুন্দরবনের গভীরে
Views: 1
সুন্দরবনের গভীরে:
সন্ধ্যা নামছে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে। পাখিদের কলরব ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে আসছে, তার বদলে শোনা যাচ্ছে দূরের বাঘের গর্জন। এই নিস্তব্ধতার মাঝে একটি ছোট্ট নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে জলের ওপর দিয়ে।
নৌকার মাঝে বসে আছে অনিল। তার চোখে উদ্বেগ, মুখে চিন্তার ছাপ। সে জানে, এই জঙ্গলে রাত কাটানো নিরাপদ নয়। কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় নেই। তার গ্রামের মানুষ তাকে বলেছে, শুধুমাত্র এই জঙ্গলের গভীরে থাকা একজন সাধু, তার স্ত্র, মালতীকে বাঁচাতে পারবেন।
মালতী। অনিলের চোখ ছলছলিয়ে ওঠে তার কথা ভেবে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মালতী অদ্ভুত এক রোগে আক্রান্ত। দিনের পর দিন সে শুধু শুকিয়ে যাচ্ছে। যেন কেউ তার জীবনীশক্তি চুষে নিচ্ছে। গ্রামের ডাক্তার, কবিরাজ – কেউই, তার রোগের কারণ বুঝতে পারেনি।
হঠাৎ অনিলের নৌকা একটা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খায়। সে চমকে ওঠে, দেখে একটা ডুবন্ত গাছের ডাল। নৌকা থেকে নেমে সে গাছটাকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু তখনি তার চোখে পড়ে – গাছের ডালে লেগে আছে একটা ছেঁড়া শাড়ির টুকরো।
অনিলের বুক ধক করে ওঠে। এই নির্জন জঙ্গলে একটা শাড়ির টুকরো! সে আবার নৌকায় উঠে বসে, কিন্তু এবার তার মনে একটা অজানা আশঙ্কা ঢুকে পড়ে।
ঘণ্টাখানেক পর অনিল পৌঁছায় একটা ছোট্ট দ্বীপে। দ্বীপের মাঝখানে একটা প্রাচীন মন্দির, তার সামনে জ্বলছে একটা আগুন। অনিল নৌকা থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগোয় মন্দিরের দিকে।
“কে?” একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে অন্ধকার থেকে।
অনিল চমকে ওঠে। “আমি… আমি অনিল। আপনার সাহায্য চাই, বাবা।”
একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে আসেন আগুনের আলোয়। তাঁর লম্বা সাদা দাড়ি, শরীরে ভস্ম মাখা। তিনি অনিলকে দেখে বলেন, “তুমি এখানে কেন এসেছ, বাছা?”
অনিল কাঁপা গলায় বলে, “আমার স্ত্রী, বাবা। সে মরণাপন্ন। আপনি ছাড়া আর কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না।”
বাবা অনিলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান। “তোমার স্ত্রীর কী হয়েছে?”
অনিল সব কিছু খুলে বলে। শোনার পর বাবা চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, “তোমার স্ত্রীকে গ্রাস করেছে একটা পিশাচ। একটা আত্মা যা মানুষের জীবনীশক্তি খেয়ে বেঁচে থাকে।”
অনিলের শরীর শিউরে ওঠে। “কিন্তু কেন? কেন সে আমার মালতীকে বেছে নিল?”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। “এই পিশাচ হল একজন মেয়ের আত্মা, যে অকালে মারা গিয়েছিল। তার জীবন ছিল অপূর্ণ, তাই সে এখন অন্যের জীবন কেড়ে নিয়ে নিজের অপূর্ণতা মেটাতে চায়।”
“কিন্তু আমরা কী করতে পারি?” অনিল প্রায় কেঁদে ফেলে।
বাবা বলেন, “আমরা পিশাচকে বাধ্য করতে পারি তোমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু তার জন্য আমাদের যেতে হবে জঙ্গলের সবচেয়ে অন্ধকার অংশে, যেখানে পিশাচ বাস করে।”
অনিল মাথা নাড়ে। “আমি যেতে প্রস্তুত।”
বাবা একটু হাসেন। “তোমার সাহস আছে, বাছা। কিন্তু মনে রেখো, এই পিশাচ খুবই শক্তিশালী। সে তোমার মনকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। তুমি কি নিশ্চিত যে তুমি এই ঝুঁকি নিতে চাও?”
অনিল দৃঢ়ভাবে বলে, “হ্যাঁ, বাবা। আমি মালতীকে বাঁচাতে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত।”
বাবা মাথা নাড়েন। “বেশ। তাহলে চলো।”
তারা দুজনে নৌকায় উঠে পড়ে। বাবা একটা মন্ত্র পড়েন, আর নৌকা নিজে থেকেই চলতে শুরু করে। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, শুধু দূরে দূরে জোনাকির আলো জ্বলজ্বল করছে।
কিছুক্ষণ পর নৌকা থেমে যায় একটা বিশাল বটগাছের সামনে। গাছের গুঁড়ি ফাঁপা, তার ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত আলো বের হচ্ছে।
বাবা বলেন, “এই গাছের ভেতরেই থাকে পিশাচ। আমরা এখন ভেতরে যাব।”
অনিল ভয়ে কাঁপতে থাকে, কিন্তু মালতীর কথা ভেবে সাহস সঞ্চয় করে। তারা দুজনে গাছের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ভেতরে ঢুকেই অনিল অবাক হয়ে যায়। গাছের ভেতরটা অনেক বড়, যেন একটা বিশাল হলঘর। চারদিকে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে। হলঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে – তার শরীর স্বচ্ছ, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
পিশাচ অনিলের দিকে তাকিয়ে হাসে। “স্বাগতম, অনিল। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
অনিল চমকে ওঠে। “তুমি আমার নাম জানো?”
পিশাচ আবার হাসে। “আমি সবই জানি, অনিল। আমি জানি তুমি কেন এসেছ। তুমি তোমার স্ত্রীকে বাঁচাতে চাও।”
বাবা এগিয়ে আসেন। “তুমি এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে ছেড়ে দাও। সে তোমার নয়।”
পিশাচের চোখ জ্বলে ওঠে। “সে আমার! আমি তাকে ছাড়ব না!”
অনিল বলে, “কিন্তু কেন? কেন তুমি আমার মালতীকে নির্বাচন করলে?”
পিশাচ অনিলের দিকে ফিরে। “কারণ সে সুখী। তার জীবনে আছে প্রেম, আনন্দ – যা আমার কখনোই হয়নি। আমি মারা গিয়েছিলাম বিয়ের আগেই, কখনো প্রেম পাইনি। তাই আমি এখন অন্যের সুখ কেড়ে নিয়ে নিজের অপূর্ণতা মেটাতে চাই।”
অনিলের চোখে জল আসে। “কিন্তু এভাবে তো তুমি আরও অশান্তি বাড়াচ্ছ। তুমি যা চাইছ তা এভাবে পাবে না।”
পিশাচ চিৎকার করে ওঠে। “তুমি কী জানো আমার ব্যথা? আমার অপূর্ণতা?”
বাবা শান্তভাবে বলেন, “আমরা তোমার ব্যথা বুঝতে পারি। কিন্তু এভাবে অন্যের জীবন নষ্ট করে তুমি কখনোই শান্তি পাবে না।”
পিশাচ হঠাৎ কেঁদে ফেলে। “তাহলে আমি কী করব? আমি এই অন্ধকার থেকে কীভাবে মুক্তি পাব?”
অনিল এগিয়ে যায় পিশাচের দিকে। “তুমি মুক্তি চাও? তাহলে অন্যকে মুক্তি দাও। আমার মালতীকে ছেড়ে দাও।”
পিশাচ অনিলের দিকে তাকায়। তার চোখে এখন আর রাগ নেই, আছে শুধু বেদনা। “কিন্তু তাহলে আমার কী হবে?”
বাবা বলেন, “তুমি মুক্তি পাবে। তোমার আত্মা শান্তি পাবে।”
পিশাচ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। “ঠিক আছে। আমি তোমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিচ্ছি।”
হঠাৎ একটা তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অনিল চোখ বন্ধ করে ফেলে। যখন সে আবার চোখ খোলে, দেখে পিশাচ আর নেই। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দর মেয়ে, যার মুখে শান্তির হাসি।
মেয়েটি বলে, “ধন্যবাদ, অনিল। তোমার করুণা আমাকে মুক্তি দিয়েছে। আমি এখন শান্তিতে যেতে পারব।”
অনিল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, তার শরীর থেকে একটি নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
বাবা অনিলের কাঁধে হাত রাখেন। “তুমি একটি আত্মাকে মুক্তি দিয়েছ, বাছা। এটা একটা মহৎ কাজ।”
অনিল জিজ্ঞাসা করে, “কিন্তু মালতী? সে ঠিক আছে তো?”
বাবা মাথা নাড়েন। “হ্যাঁ, সে এখন ভালো হয়ে যাবে। চলো, আমরা ফিরে যাই।”
তারা আবার নৌকায় উঠে পড়ে। ফেরার পথে অনিল লক্ষ্য করে যে জঙ্গলটা আর তত ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। এমনকি পাখিরাও আবার ডাকতে শুরু করেছে।
সকাল হতে না হতেই তারা গ্রামে ফিরে আসে। অনিল দৌড়ে যায় তার বাড়ির দিকে। ঘরে ঢুকেই সে দেখে মালতী বিছানায় উঠে বসে আছে, তার মুখে স্বাভাविক রঙ ফিরে এসেছে।
মালতী অনিলকে দেখে হাসে। “তুমি কোথায় ছিলে? আমি কত ভয় পেয়েছিলাম।”
অনিল মালতীকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
কিছুদিন পর, অনিল আর মালতী সুন্দরবনের সেই মন্দিরে যায় বাবাকে ধন্যবাদ জানাতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা দেখে মন্দিরটা খালি। কোথাও বাবার দেখা নেই।
মন্দিরের দেয়ালে লেখা রয়েছে: “যারা সত্যিকারের ভালোবাসে, তাদের কাছে কোনো অন্ধকারই চিরস্থায়ী নয়।” (কথক বাবা দুজনেই বলবে )
অনিল আর মালতী এই কথাগুলো পড়ে। তারা বুঝতে পারে যে তাদের জীবনে যে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু তাদের প্রেমের জন্যই সম্ভব হয়েছে।
সেদিন থেকে, প্রতি বছর পূর্ণিমার রাতে, অনিল আর মালতী সুন্দরবনের সেই মন্দিরে যায়। তারা সেখানে বসে গল্প করে সেই রাতের কথা, যখন তাদের প্রেম একটি হারানো আত্মাকে মুক্তি দিয়েছিল।
আর মাঝে মাঝে, যখন জঙ্গলে সন্ধ্যা নামে, তখন দূরে একটি মেয়ের গান ভেসে আসে – একটি সুরেলা, মধুর কণ্ঠস্বর। গ্রামের লোকেরা বলে, এটা নাকি সেই মুক্ত আত্মার গান, যে এখন শান্তিতে বিচরণ করে সুন্দরবনের গভীরে।
কিন্তু অনিল আর মালতী জানে, এটা শুধু একটি গান নয়। এটা একটি স্মৃতি – একটি স্মরণ সেই রাতের, যখন প্রেমের শক্তি অন্ধকারকে জয় করেছিল।
তারা প্রতিদিন এই গল্প তাদের সন্তানদের শোনায়, যাতে তারা জানতে পারে যে প্রকৃত ভালোবাসা কত শক্তিশালী। যে ভালোবাসা শুধু দুটি হৃদয়কে একত্রিত করে না, বরং একটি হারানো আত্মাকেও মুক্তি দিতে পারে।
এভাবেই, অনিল আর মালতীর প্রেমের গল্প একটি কিংবদন্তিতে পরিণত হয় – একটি গল্প যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বলা হবে, একটি গল্প যা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে প্রেমের শক্তি সব কিছুকে জয় করতে পারে, এমনকি মৃত্যুকেও।
আর যখনই কেউ সুন্দরবনের গভীরে যায়, তখন তারা মনে রাখে এই গল্প। তারা জানে যে এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে শুধু বাঘ আর কুমির নয়, আছে আরও অনেক রহস্য – রহস্য যা শুধু প্রকৃত প্রেমের মাধ্যমেই উন্মোচিত হতে পারে।
এভাবেই, অনিল আর মালতীর প্রেমের গল্প সুন্দরবনের একটি অংশ হয়ে যায় – একটি গল্প যা জঙ্গলের প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি নদীর জলে, প্রতিটি পূর্ণিমার রাতে ধ্বনিত হয়।
আর যখনই কেউ জঙ্গলে হারিয়ে যায়, যখনই কেউ ভয় পায়, তখন তারা শুনতে পায় সেই মধুর কণ্ঠস্বর – একটি গান যা তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রেম সব সময় পথ দেখায়, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Soumen Sadhukhan |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Debanshu Ghosh |
Characters | Name |
---|---|
Sadhu Baba | Debanshu Ghosh |
Anil | Joydeep Lahiri |
Pichash | Olivia Das |
Maloti | Susmita Ghosh Das |
Find us on Facebook – click here