বিদেহী আত্মার ভালোবাসা
Views: 103
বিদেহী আত্মার ভালোবাসা:
ভালোবাসা! —-
কেউ জানে আসল ভালোবাসার রকম। কেউ বলে ভালোবাসায় পাগল হয়, কেউ বলে ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার ভালোবাসায় প্রতিহিংসা-পরায়ণ হয়। আবার কেউ ভালোবাসায় ত্যাগীও হয়। কিন্তু ভালোবাসা কতদূর যায় – ইহকালে না হলে কি পরকালে গিয়ে আত্মা আত্মায় মিল হয়?
হয় – হয়।
বেহালায় মধ্যবিত্ত দুটি পাশাপাশি বাড়ি। দুটি বাড়ির মধ্যে বেশ মেলামেশা ভাব ভালোবাসা ছিল। এক বাড়ির মালিকের নাম, নবীনবাবু অর্থাৎ নবীনবরণ দে। পেশায় ব্যবসা। আর এক বাড়ির মালিকের নাম সুজন রায়, পেশায় হোমিওপ্যাথি ডাক্তার।
নবীনবাবু নামে নবীন হলেও মনটা তার প্রাচীন পন্থি। আর সুজন বাবু নামেও সুজন, প্রকৃতিতে সুজন মানুষ। নবীন বাবুর একটি মেয়ে নন্দিতা। আর সুজন বাবুরও একটি ছেলে নির্মাল্য। নির্মাল্য খুব শান্ত প্রকৃতির ছেলে। মিষ্টি স্বভাব। ছোটবেলায় মা মারা যায়। সুজনবাবু আর বিবাহ করেননি। একাধারে মা বাবার অপত্য স্নেহ দিয়ে মানুষ করেন নির্মাল্যকে। নির্মাল্য ডাক্তারি পড়ছে। সুজনবাবু কষ্টে শিষ্টে মানুষ করছেন নির্মাল্যকে।
হঠাৎ নবীনবাবু বাঁহাত কা খেল দেখিয়ে বেশ কিছু পয়সা করে নিলেন। মধ্যবিত্ত পাড়া ছেড়ে, ধনীপাড়ায় বাড়ি কিনলেন। মেলামেশাও ধনীদের সাথেই হয়। নবীনবাবুর স্ত্রী , যদি পুরোনো দিনের কথা বা পুরোনো বাড়ির সম্বন্ধে বললে নবীনবাবু খুবই বিরক্ত হন। মেয়েকেও বলে দিয়েছেন পুরোনো পাড়ায় বা সুজনবাবুর ছেলের সাথে যেন মেলামেশা না করে। আগের মতো সে মধ্যবিত্ত নয়। এখন তার বাবার পয়সা হয়েছে| মান সম্মান বেড়েছে, মেয়েকে স্ত্রীকে বলে দিয়েছেন যেন সব সময় ফিট ফাট থাকে। বাড়িতে অনেক কাজের লোক রেখেছেন।
কিন্তু নন্দিতার এসব কিছুই ভালো লাগে না। ওর মন পড়ে থাকে তার ফেলে আসা দিনে। নির্মাল্য ও তার মেলামেশা গল্প, হাসি, ঘোরাফেরা। নির্মাল্যর বাবার অপত্য স্নেহ ভালোবাসা। মনে হয় এক্ষুনি সেখানে চলে যায়, মাকে বলেও মাঝে মাঝে। কিন্তু নবীনবাবু নির্মাল্যক স্পষ্ট বলে দিয়েছে, সে যেন এখানে না আসে। নন্দিতার সাথে না মেলামেশা করে। নন্দিতাকে ভালো আরো বড়ো ঘরে বিয়ে দিয়ে বাইরে পাঠাবেন। তিনি সেই চেষ্টা করছেন। সেই জন্য নবীনবাবুর স্ত্রী ভয়ে আর মেয়েকে প্রশ্রয় দেয় না। এই ভাবেই বয়ে গেল কয়েকটা বছর।
নির্মাল্যর বাবা মারা যাবার পর নির্মাল্য তাদের বাড়ি বিক্রী করে সরকারি হাসপাতালে চাকরি নিয়ে সুদূর গ্রামে চলে যায়। নিয়ে যাবার মধ্যে নিয়ে যায় শুধু নন্দিতার একটা ছবি। তাও তার মোবাইলে তুলে ছিল। সেটা আকড়ে আর নন্দিতার স্মৃতি ধরে দিন কাটায়।
এদিকে নন্দিতা জানে নির্মাল্য কোথায় গেছে ,কি করছে। বিয়ের আগে পর্যন্ত সিম পাল্টিয়ে ফোনে নির্মাল্যর সাথে কথা হতো। কিন্তু একদিন নবীনবাবুর নজরে আসে নন্দিতার ফোনের কললিস্টে। নির্মাল্যর নাম আর নম্বর সেভ করা আছে। মাথায় আগুন জ্বলে যায়। হাঘরের ছেলের নম্বর ওর ফোনে।
কাউকে কিছু না জানিয়ে তলে তলে নন্দিতার সম্বন্ধ দেখাশোনা করে। সব ঠিক করে বাড়িতে একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। স্ত্রীকে মেয়েকে বলেন,
— “তাঁর কয়েক জন পুরোনো বন্ধুরা আসবে”।
ব্যাস এইটুকু। নবীনবাবুর স্ত্রী মিতালী দেবী ভীষণ ভয় পেতেন স্বামীকে। মেয়ে নন্দিতাও তাই হয়েছে। ওদের সখ, ইচ্ছার, আনন্দের কোনো মূল্য দিতেন না। যাই হোক, দুদিন পরে নবীনবাবুর বন্ধু মহেশ সেন, স্ত্রী প্রমীলা দেবী ও তাঁদের দেবেশ ও দেবেশের বন্ধু শিবনাথ এল দেখতে নন্দিতাকে। নবীনবাবু সকাল থেকেই বলে রেখেছেন তাঁরা আসবেন, নন্দিতা যেন বাড়ির বাইরে না যায়।
দোকান থেকে ভালো ভালো মিষ্টি আনিয়েছেন, নবীনবাবুর স্ত্রী ও মেয়ে বুঝতেই পারছে কেনো তাঁরা আসছেন। মেয়ে দেখে সবাই -এর পছন্দ হল, এবং যথাসময়ে দিন পনেরোর মধ্যে নন্দিতার বিয়ে হয়ে গেল।নন্দিতা ফোনে নির্মাল্যকে বলেছিল সব কারণ, বাড়ি থেকে বেরোনো তার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সব শুনে নির্মাল্য শুধু বলেছিল,
— ” তুমি সহ্য করে যাও। ইহকালে তোমার আমার মিলন হল না বলে দুঃখ করোনা, পরকাল বলে কিছু যদি থাকে তো দেখো ঠিক মিল হবেই।”
নন্দিতা খুব ভালোবাসতো নির্মাল্যকে। মেনেও নিল নির্মাল্যর উপদেশ। সেও ভেবে নিল ইহকাল বলে নিশ্চই কিছু আছে, আর সেখানেই সে আর নির্মাল্য মিলিত হবে। সেখানে আর কোনও বাধা আসবেনা, তার বাবা থাকবে না, থাকবেনা কোনো বৈষম্য, থাকবেনা কোনো শাসনের ঘেরা টোপ, ভয়। চুপচাপ মলি মুখে সব মেনে নিল। শুধু একজন বুঝতে পারলো যে নন্দিতা স্বেচ্ছায় কিভাবে হাঁড়িকাঠে মাথা দিল। বেদনায় বুক মুচড়ে উঠল, তিনি আর কেউ নন নন্দিতার মা মিতালী দেবী। চোখের জল মুছে হাসি মুখে সব কাজ করতে লাগলেন।
বিয়ে হয়ে গেল নন্দিতার। পরদিন কনে বিদায়ের সময় একটা টেলিগ্রাম এল নন্দিতার নামে। হাতে পড়ল নন্দিতার। চোখে তার জল নেই, মোছার দরকারও নেই । এই বাপের হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেওয়া যায় ততই মঙ্গল। মায়ের জন্য মনটা একটু কাঁদে তা কি করা যাবে। যাই হোক টেলিগ্রামটা খুলে পড়ে নন্দিনীর মুখটা আরো গম্ভীর আরো শক্ত হল। দাঁতে দাঁত চেপে চৌকাঠ পেরিয়ে গেল। নবীনবাবু দেখেও না দেখার ভাব করে জিজ্ঞাসা করলেন —” কি রে , কি এল?”
-‘কিছু না।’ বলে নন্দিতা গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল, পাশে বর উঠে বসলো।
গাড়ি ছেড়ে দিল। পরের দিন বৌভাতে তে নবীনবাবুর স্ত্রী ও নবীনবাবু কনেযাত্রীদের সাথে নন্দিতার বৌভাতে গেলেন। নবীনবাবু ভুলে যাননি যে নন্দিতা বিদায় বেলায় একটা টেলিগ্রাম এসেছিল। আর তা নন্দিতাই খুলে পরে ছিল। তাই তিনি স্ত্রী মিতালী দেবী কে দিয়ে মেয়ে কে জিজ্ঞাসা করতে বললেন। মিতালী দেবী বলেন,
— “কেন তুমি জিজ্ঞাসা করতে পারছো না নিজে।”
নবীনবাবু বলেন,—
“আমায় বলবে না, তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করো।”
বৌভাত বাড়িতে গিয়ে মিতালী দেবী মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন মনে মনে। এ কাকে দেখছেন, এ তো নন্দিতা নয়। এতো একটা দম দেওয়া পুতুল। বসালে বসছে, ওঠালে উঠছে, হাসালে হাসছে, বলালে বলছে। ওর মধ্যে যেন প্রাণ নেই।এত সাজগোজ গয়নাগাটি পরে আছে তবু মুখটা মরার মুখের মতন ফ্যাকাসে।
মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়েকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
—“কি হয়েছে মামনি, আমায় বল?তোকে দেখে আমার ভালো লাগছে না।”
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নন্দিনী বলল,
—“কাল বেরোনোর সময় একটা টেলিগ্রাম এসেছিল মা “। বলে থেমে গেল নন্দিতা।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে শুধু বলল,
—“নির্মাল্যর দুদিন আগে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। গতকাল ভোর রাত্রে মারা গেছে “। বলে চুপ করে যায়।
কেঁপে ওঠেন মিতালী দেবী। মেয়েকে চেপে ধরে কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আস্তে আস্তে
—” তুই একটু কাঁদ মা, চেপে থাকিস না। তোর বুক ফেটে যাচ্ছে জানি। তুই একটু কাঁদ”।
পাথরের মতো বসে থাকে নন্দিতা। সবাই ভাবে মেয়ের জন্য মা কাঁদছে।নন্দিতা তো আগেই পাথর হয়েছে। আর নতুন করে কি হবে।
এবারে আসল গল্পে আসি। বছর পাঁচেক কেটে গেছে, নন্দিতার একটি ছেলে হয়েছে। নন্দিতাকে নিয়ে কারোর কোনো সমস্যা নেই। না তার শাশুড়ির না শ্বশুরের না স্বামীর না ছেলের। সব দিকে সমান চোখ তার। কিন্তু সবাই একটি কথাই বলে, নন্দিতাকে কেউ কোনোদিন জোরে হাসতে দেখেনি একটু মুচকি হাসি। কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখেনি। বেশী কথা বলতে দেখেনি – যে টুকু প্রশ্ন সেটুকু উত্তর। আর অষ্টমঙ্গলার পর বাপের বাড়ি যেতে দেখেনি বা নন্দিতাও যেতে চাইতো না।
তবে নন্দিতা কখনো ফটো তুলতে চাইতো না কোনোদিন ক্যামেরায়। কেন? সে কথা সে কোনোদিন কাউকে বলেনি। এইভাবে বছর যায় ছেলে বড়ো হয়। কিন্তু নন্দিতা একমুহূর্তের জন্যও নির্মাল্যকে ভোলেনি। এক সময় সে যেন অনুভব করতে লাগল’ তার আশেপাশে কেউ আছে। হাত বাড়ালেই তাকে ধরতে পাবে।
একবার মোবাইলে নিজের ফটোর জন্য সেলফি তুলতে গিয়ে দেখে, তার পাশে আবছায়া কার ফটো উঠেছে।সেই থেকে সে ফটো তুলতে চায়না। ছেলে মাধ্যমিক পাশ ভালোভাবে করলে, তার বাবা তাকে ক্যামেরা প্রেজেন্ট করে। প্রথম ক্যামেরা পেয়ে ছেলের ভীষণ সখ হল বাবা মায়ের ছবি তুলতে। নন্দিতা তো কিছুতেই তুলবে না। জোর করে ধরে বেঁধে স্বামীর পাশে দাঁড়ালে ফটো তুললো ছেলে। কিন্তু ফটো যখন হাতে এল, দেখে নন্দিতার পাশে ওর স্বামীর ছবি নেই তার বদলে আবছায়া আর একজনের ছবি? সবাই অবাক হয়ে গেল। ভাবল ছেলে মানুষের নতুন হাত কি জানি কি হয়েছে। নন্দিতা বুঝতে পারে, মনে মনে হাসে আর মনে মনে ভাবে,
-“নাগো নির্মাল্যদা তোমার ভয় নেই আমি তোমারই আছি।এই পার্থিব দেহটাই সবাই দেখে সবাই ভাবে আমি এই জগতেই আছি। দেহটা পায় মনটা তো তোমার সঙ্গে আছে। আর অপেক্ষা করতে হবেনা তোমায়! আমার সময় হয়ে এসেছে ।”
হঠাৎ কিছুদিন পর নন্দিতার জ্বর হলো, খুব জ্বর। ডাক্তার এল চিকিৎসা হলো। কিন্তু না কোনো রোগই ধরতে পারলো না ডাক্তার। চার/পাঁচ দিন জ্বরে ভুগে মারা গেলো নন্দিতা। তার পার্থিব দেহ রইলো পরে পৃথিবীতে, তার আত্মা গিয়ে মিললো পরম পাওয়ার বিদেহী আত্মা নির্মাল্যর সঙ্গে, অতীব শান্তি আর অফুরন্ত আনন্দে বিলীন হয়ে গেল স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে সেখানে।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Kaberi Ghosh |
Narrator | Olivia Das |
Introduction | Priyanka Dutta |
Characters | Name |
---|---|
Nandita | Priyanka Dutta |
Nirmalya | Debanshu Ghosh |
Mitali debi | Shreya Lahiri |
Nabin babu | Joydeep Lahiri |
https://www.facebook.com/srijoni
Just awesome..
osadharon lekha….. story line darun