উত্তরণ
Views: 19
উত্তরণ:
অভীক আজ বাবার সাথে কলকাতায় বই মেলায় যাচ্ছে| ওদের বাড়ি সিঙ্গুর| সিঙ্গুর থেকে ট্রেনে করে হাওড়া| তারপর ওখান থেকে বাসে করে সল্ট লেকে,বইমেলায়| বাড়ি তে বিশেষ কোনো বই নেই| আর ওর ও বিশেষ কোনো শখ নেই বই পড়ার কিন্তু আজ ওদের বইমেলাটা যাওয়া খুব জরুরি|
বছর আটেকের অভীক ট্রেন এ উঠে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো | সামনে সাদা পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক কে অভীক এক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগলো| একবার বাবার মুখের দিকে চেয়ে দেখলো| তারপর মুখ নামিয়ে আবার একনজরে সেই ভদ্রলোককে লক্ষ্য করতে লাগলো| কাঁধে একটি নীল রঙের ঝোলানো ব্যাগ | মধ্যবয়স্ক হলেও চেহারায় একটা দীপ্তি আছে | মুখে একটা অদ্ভুত শান্তির ছাপ|
হাওড়া স্টেশন আসা অবধি ভিড় আরও বাড়তে লাগলো| আর ক্রমশ লোকটার সাথে ব্যাবধান কমতে লাগলো ওদের | কিছুক্ষন বাদে অভিকের বাবা অভীক কে বললো,
-“যাও”|
অভিকের গলা শুকিয়ে আস্তে লাগলো ভয়ে | বাবার হাত আরও চেপে ধরলো কিন্তু তার বাবা আরও গম্ভীর ভাবে আদেশ দিলো,
-“যাও বলছি!”
অভীক আস্তে আস্তে সেই ভদ্রলোকটির দিকে পা বাড়াতে লাগলো| আজ তার প্রথম পকেটমারির কাজ|তার মনে পড়লো সে আর অন্য সাধারণ বাচ্ছাদের মতন নয়| সে একজন পকেটমারের সন্তান|
আজ ৩ বছর হলো অভীক মা কে হারিয়েছে| ২ বছর আগে বাবার মিলের চাকরিটাও চলে গেলো| তখন থেকে অভিকের স্কুল যাওয়াও শেষ| তখন টাকার অভাবে বই কিনতে না পারায় অভীক প্রথম চুরি করে এনেছিল একটা বাংলা বই তার পাশের ডেস্কের ইন্দ্র এর থেকে | তারপর দিনের পর দিন অনাহার , ছেঁড়া কাপড় যেন তাদের জীবন সঙ্গী হয়ে দাড়িয়েচিলো|
দরিদ্রতা মানুষের জীবনের সাথে সভ্যতাও কেড়ে নেয়| ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অভিকের বাবা পকেটমারের জগতে পা রাখলো| মোটামুটি ভাগ্য থাকলে 8 -৫ শো টাকা জোটে আর ভাগ্য সহায় না থাকলে প্রাপ্তি গণধোলাই না হলে পুলিশের প্রহার| এই দেড় বছরে তার বাবা অনেকবার বাড়ি ফিরেছে ছেঁড়া জামা,ভাঙা হাত নিয়ে,আবার কোনোদিন বাড়িই ফেরেনি | অভীক তার বাড়ির উঠোনে দরজার দিকে কাঁদতে কাঁদতে চেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানতেও পারতো না| সকালে বাবা এসে যখন গায়ে হাত দিয়ে ডাকতো তখন ঘুম ভাঙতো| বাবা বলতো,
-“রাতে আস্তে পারলাম না সোনা, পুলিশে…”
এই করে দেড় বছর কেটে গেলো | অভীক একটু বোরো হয়েছে | তাই ওর বাবা ঠিক করেছে যে অভীককে তাদের ব্যবসা হাতে কলম এ শেখাবে | যদি ওর নিজের কিছু হয়ে যায় কোনোদিন তাহলে ছেলেটা…” এই ভেবেই তার বাবা আজ ওকে নিজের সাথে নিয়ে এসেছে| ভিড়ের মধ্যে অভীক কে সহজে কেউ ধরতে পারবে না| আর বইমেলার ভিড়ে কাজটাও সোজা হবে|
অভীক এইসব কথা ভাবতে ভাবতে যে কখন যে দাঁড়িয়ে পড়েছে খেয়াল নেই| সামনে লোকটা এখনো দাঁড়িয়ে| অন্যমনস্ক | একবার পেছনে বাবার দিকে ঘুরে তাকাল| বাবা চোখে ইশারা করলো যেতে |
অভীক এগোলো | তারপর আস্তে করে ভদ্রলোকটার পাশে এসে দাঁড়াল| তারপর আস্তে করে সাদা পাঞ্জাবির পকেটে হাতটা ঢুকে গেলো| চামড়ার স্পর্শ অনুভব করলো আঙুলে| এবার ওয়ালেট টা তার হাতে চলে এলো | ভদ্র লোকটি টের ও পেলো না| অদ্ভুত ভাবে অন্যমনস্ক| ও পারল| প্রথম কাজ| প্রথম| আজ ও পকেটমার হয়ে গেলো|
বইমেলায় পৌছে অভীক হা হয়ে গেলো| এতো লোক,দোকান ও কোনোদিনও আগে দেখেনি| বাবাকে অনেক বিফল অনুরোধ করার পর চোখের জলের সাহায্য নিয়ে বাবাকে একটা দোকানে নিয়ে আসতে ও সক্ষম হল| ওর একটা বই কেনার ইচ্ছা হল | “উত্তরণ”- নবীন কুমার দাসগুপ্ত , বইটা দেখে পছন্দ করলো ও | কিনতে চাইলো যখন তখন ওর বাবা প্রতিশ্রুতি দিলো যে -” আর একটা-দুটো সাফ করে নি, তার পর কিনে দেব|”
অভীক ছলছল চোখে বইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলো | আরেক যুবক এর পকেটের ওজন হালকা করার পর ওর বাবা একজন সবুজ সারি পরা মহিলা কে আগামী শিকার বলে সনাক্ত করলো| সমস্ত উপার্জন যা ছিল অভীক এর পিঠে একটা ছোট ব্যাগ এর মধ্যে ভরে ওর বাবা অগ্রসর হলো সন্তর্পনে |
বাবার সাথে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো ও| ভদ্রমহিলার দান হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ ঝোলানো|
ওদের লক্ষ্য ওটা| ধীর কদমে গিয়ে ওর বাবা মহিলাটার পেছনে দাঁড়াল | অভীক ও পাশে এসে দাঁড়াল | কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো ওর মনে| ও ডাকলো,
-“বাবা!”
ওর বাবা একবার হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে| তারপর আবার ভদ্রমহিলার দিকে ফিরে গেলো| অভীক দেখতে লাগলো নিষ্ফলকে| কিন্তু ওদের ভাগ্য আর সঙ্গে দিলো না এবার| মহিলাটি হাতে টান অনুভব করা মাত্রই চেঁচালেন,
-“চোর,চোর!!”
ওর বাবা ছেলের হাত ধরে এক হাতে ব্যাগ নিয়ে পালতে শুরু করলো| কিন্তু পেছনে ওদের এক পাল লোক| ওর বাবা কে এসে ওরা ধরে ফেললো | ওর বাবা অভীক এর হাত ছেড়ে দিলো| একটা লাথি খেয়ে ওর বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো| গণপ্রহার এর সূচনা হলো| অভীক একটা পাথর তুলে ক্ষীণ প্রতিরোধের সুরে ভিড়ের দিকে ছুড়লো| একজনের মাথা ফেটে গেলো| ওর বাবা চিৎকার করে বললো,
-“পালা! অভীক পালা!”
অভীক এর পেছনে তখন কিছু লোক ধাওয়া করেছে | অভীক জ্ঞানশূন্যহীন ভাবে ছুটতে লাগলো| একবার জল ভরা চোখে পেছনে ঘুরে বাবার রক্তাক্ত মুখটা দেখতে পেলো বিকেলের আলোয় | তারপর আবার ছুটতে লাগলো| অনেকক্ষন বাদে এসে এক জায়গায় থামলো ও | বুঝতে পারল ও বাবার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে| ও বাবার কাছে ফিরতে চাইলো|
অনেক খুঁজেও রাস্তা পেলো না| চাপা একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো গলা থেকে ওর | “বাবা,বাবা” বলে কাঁদতে কাঁদতে , খোঁজার চেষ্টা করলো| ভিড়ের মধ্যে এই ক্ষীণ কান্না কোথায় যেন চাপা পরে গেলো|
কিন্তু এই কোলাহলের এর মধ্যেও এক বেক্তির মনোযোগ আকৃষ্ট করলো অভীক| সে লক্ষ্য করলো একটা বাচ্চা অনর্গল কেঁদে চলছে ও দিক বিহীন ভাবে কাউকে খুঁজে চলেছে | কাছে এসে অভীক কে কোলে তুলে নিলো ভদ্রলোক| অভীক সেই ভদ্রলোক কে দেখা মাত্রই ভয়ে আরো কেঁদে ফেললো |
লোকটির পরনে সাদা পাঞ্জাবিটা অভীক এর সদ্য পরিচিত| সকালে ট্রেনে এনার পকেট থেকেই একটা পায়সা বোঝাই ওয়ালেট নিয়েছে ও| ভদ্রলোক ওকে চুপ করানোর চেষ্টা করলেন | জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে|
অভীক সত্যি কথাটা আস্তে আস্তে বলে ফেললো| ভাবলো ভদ্রলোক হয়তো এখুনি ওকে কোল থেকে নামিয়ে দেবেন বা পুলিশের হাতে তুলে দেবেনা | কিন্তু আশ্চর্য ভাবে ভদ্রলোকটি এমন কিছু করলেন না|
ওর বাবাকে খুঁজে বের করলেন ভদ্রলোক | ওর বাবা তখন অজ্ঞান অবস্থায় এক স্টলের ধারে পরে ছিল| অনেক লোক ঘিরে ধরেছে| জামাকাপড় ছেড়া, নাক থেকে রক্ত ঝরছে| মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে বুকে পড়ছে| ধুলো আর রক্ত মিশে এক জমাট পদার্তের সৃষ্টি হয়েছে শরীরের চারিপাশে| পুলিশ এ খবর দেয়া হয়েছে| ভদ্রলোক সকলকে বুঝিয়ে ওর বাবা কে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করলেন|
হাসপাতালে ওর বাবার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ছেলেকে পাশে দেখে বুকে টেনে নিলো| সামনে ওই ভদ্রলোককে দেখে অবাক হলো| ছেলের কাছ থেকে সব সোনার পর অপরাধবোধ ওর বাবার হৃদয় কে বিদীর্ণ করলো| ভদ্রলোকটি কাছে এসে ওর বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“এখন কেমন লাগছে?”
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না ওর বাবা,বললো,
-“হুজুর আমায় মাফ করবেন, আমি আপনার টাকা চুরি করেছে ট্রেনে “|
বলে ভদ্রলোকের পা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো | ছেলেকে তার ওয়ালেট টা ফেরত দিতে বললো | ভদ্রলোক কিন্তু ফেরত নিলেন না, বললেন,
-“আমি শুনেছি তোমার ছেলের কাছ থেকে, কিন্তু আমায় যদি টাকাটা ফেরত দিয়ে দাও, তাহলে হাসপাতাল এর বিলটা মেটাবে কি ভাবে? এখানে তিন হাজার টাকা দেবে আর বাকিটা দিয়ে ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিও|”
অভীক এর বাবা অভীককে আদেশ করলো ভদ্রলোককে প্রণাম করতে | যাবার আগে ভদ্রলোক অভীক কে নিজের ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে অভীক কে উপহার দিলেন | প্রথম খাতায় নিজের নাম টাও লিখে দিলেন|
বইটা দেখে অভীক চমকে উঠলো | বইটা উত্তরণ| যেটা ও বইমেলায় পছন্দ করেছিল| প্রথম পাতায় লেখা-
“উত্তরণ এ তোমায় স্বাগত জানাই,
“- নবীন কুমার দাসগুপ্ত |
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | শুভজিৎ সিনহা |
Intro & Ending | Priyanka Dutta |
Kathak | Joydeep Lahiri |
Characters | Name |
---|---|
Avik Baba | Subhajit Sinha |
Avik | Sohom Sadhukhan (Child) |
Other voice | Priyanka Dutta, Joydeep Lahiri |
Find us on Facebook – click here