ভক্তের বোঝা ভগবানে বয়
Visits: 72
ভক্তের বোঝা ভগবানে বয়:
উড়িষ্যার এক গ্রামে পুরীর মন্দিরের এক পান্ডা বাস করতেন।তাঁর নাম ছিল গীতা পান্ডা। আসল কথা হল, ঐ পান্ডা সারাক্ষন অর্থাৎ যখনই সময় পেতেন তখনি ‘গীতা’ পড়তেন বা গীতার শ্লোক আওড়াতেন। সকালে হোক সন্ধ্যায় হোক মন্দিরে যেতেন একবার। আর যখনি সময় পেতেন গীতা পড়তেন। সব সময় গীতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সংসারে তার স্ত্রী আছেন দুটি সন্তান আছেন। মন্দিরে যা উপার্জন হতো তাই দিয়ে তিনি সংসার চালাতেন। মন্দির বন্ধ থাকলে বা মন্দিরে কাজ না থাকলে ভিক্ষা করতেন। ভিক্ষাতে যা অল্পসল্প যা পেতেন তাই নিয়ে বাড়ী চলে আসতেন। এসেই ভিক্ষার জিনিস স্ত্রীর হাতে দিয়েই গীতা নিয়ে বসে পড়তেন। এই রকম এক বছর হল কি বর্ষার সময় খুব বৃষ্টি হচ্ছে। একটানা সাতদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা ঘাট সব জলমগ্ন। মন্দির পর্যন্ত বন্ধ, গুটি কয়েক পান্ডা মন্দির চালনা করছেন। আর এদিকে আমাদের গীতা পান্ডার বাড়িও মন্দির থেকে দূর। বাড়ি থেকে বেরোতে পারছেন না। ভিক্ষাতেও যেতে পাচ্ছেন না। ওনার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। উনি মহা আনন্দে গীতা পড়ে চলেছেন। স্ত্রী যখনই বলেন,— “কি গো ঘরে যে চাল বাড়ন্ত। ভিক্ষায় যান কি মন্দিরে যান”। উত্তরে গীতা পান্ডা বলেন, — “কি করে বেরোই বলতো? যা বৃষ্টি। চারিদিকে শুধু জল আর জল। না না আমি বেরোবো না। ও যা হোক চালিয়ে নাও আমি গীতা পড়ি”।
স্ত্রী রাগে দুঃখে কাঁদেন বসে। আবার উঠে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসে আহারের জোগাড় করতেন।এই ভাবেই কয়েক দিন চলে যায়।একদিন ওনার স্ত্রী কোথায় কিছু না পেয়ে সন্তানদের ক্ষুধার কান্না সহ্য করতে না পেরে গীতা পান্ডার কাছে উপস্থিত হলেন। গীতা পান্ডা নির্বিকারে ভরে গীতা পড়ে চলেছেন। ওনার স্ত্রী রাগে ওনার হাত থেকে গীতা বইটি কেড়ে নিলেন। চমকে গীতা পান্ডা বলেন, — ” আরে একি করছো। দাও বইটি দাও আমায়—
রাগে ওনার স্ত্রী বলেন, — “না এই বই আজ আমি ছিঁড়ে ফেলবো” বলেই বই এর একটি পাতা ছিঁড়ে ফেলেন। গীতা পান্ডা তাড়াতাড়ি বইটি কেড়ে নিয়ে ছেঁড়া পাতা মেঝের থেকে তুলে নিয়ে সযত্নে তুলে রাখেন। বলেন,— “রাগ করো না, এই বৃষ্টিতে কে কাকে ভিক্ষা দেবে। আহার দেবার মালিক ঐ জগন্নাথই ঠিক দিয়ে যাবেন। অপেক্ষা করো”। রাগে দুঃখে অবসন্নতায় ওনার স্ত্রী অভুক্ত সন্তানদের নিয়ে শুয়ে পড়লেন। শুয়ে শুয়ে খুব কাঁদতে লাগলেন।কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ দরজায় ঘা পড়ছে শুনতে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে পড়েন। ভাবছেন শোনার ভুল। নাঃ ঠিকই শুনেছেন। দরজায় কে যেন ঘা দিচ্ছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন ক্ষুধার জ্বালায় সবাই ঘুমোচ্ছে ।গীতা পান্ডার স্ত্রী আস্তে আস্তে উঠে দরজা খোলেন। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে । দরজা খুলে দেখেন দুটি কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। অপরূপ সুন্দর দুটি কিশোর একজন ফর্সা একজন শ্যামবর্ণ।
ফর্সা কিশোরটি বলে, —“মা, মন্দিরের পূজার ভাগ অর্থাৎ প্রসাদ, ফলমূল, মিষ্টান্ন ও নানাবিধ আহার সামগ্ৰী পাঠিয়েছে। আপনি এইসব তুলে রাখুন”।
গীতা পান্ডার স্ত্রী উঁকি দিয়ে দেখেন, প্রচুর জিনিস। সবই তাঁদেরই? বিশ্বাস হয়না। কাপড়, খাবার, ফলমূল, চাল,ডাল, সবজি। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে উনি বলেন,— “তোমরা কে বাছা? কোথা থেকে আসছো?”
ফর্সা কিশোরটি বলে,—” আমরা মন্দিরেই থাকি। আর এই গুলো মন্দিরেরই জিনিস “।গীতা পান্ডার স্ত্রী শ্যামবর্ণ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখে বলেন,— “ও কে হয় তোমার? ও মুখে হাত চাপা দিয়ে আছে কেন? পান্ডা মশাই কে ডাকি উনি ঘুমোচ্ছেন।”
ফর্সা কিশোরটি বলে,—“আমরা দু ‘ ভাই। না না পান্ডা মশাইকে ডাকতে হবে না। আমরাই সব তুলে দিচ্ছি ঘরে। আপনি সরুন।”
গীতা পান্ডার স্ত্রী পাশে সরে গেলেন। তখন ঐ দুই কিশোর সব সামগ্রী ঘরে যত্ন করে তুলে দিলো। গীতা পান্ডার স্ত্রী এতক্ষনে প্রসন্ন হয়েছেন এই সব জিনিস দেখে। তখন উনি কিশোর দুটিকে বললেন, ” তোমরা এত পরিশ্রম করে এই বৃষ্টিতে এলে, এরই থেকে কিছু খেয়ে জল খেয়ে যাও।”
ফর্সা কিশোরটি বলে,—“না মা, আমরা কিছু খাবো না। আর ভাই তো কিছুই খেতে পারবে না,—“কেন, ও মুখে হাত দিয়ে আছে কেন?” শ্যামবর্ণ কিশোরটির দিকে চেয়ে বলেন, গীতা পান্ডার স্ত্রী।ফর্সা কিশোরটি বলে,—“আমি খেয়েই এসেছি। আর ভাই এর জিহ্বা কেটে গেছে। তাই ও আজ কিছু খেতে পারছে না।ঠিক আছে, আমরা চলে যাচ্ছি। বলে কিশোর দুটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে গীতা পান্ডার ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেন, বলেন —“কি হয়েছে গিন্নী? কে এসেছিলো?”
গীতা পান্ডার স্ত্রী বলেন,— “ঐ মন্দির থেকে দুই কিশোর এসেছিলো। বৃষ্টিতে কেউ আসতে পারছিল না। তাই ওদের দুইজনকে বলেছে, তাই ওরা মন্দিরের ভোগের ভাগ দিয়ে গেল।” কথা শেষ হবার আগেই গীতা পান্ডা উঠে ছুটে দরজা খুলে বাইরে বৃষ্টিতে বেরিয়ে যান । গৃহিণীও ছুটে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । কিছুক্ষন পরে গীতা পান্ডা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এসে ঘরে ঢুকে ধপ করে বসে পড়ে। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন,—“কোথায় গিয়ে ছিলে, ওদের দেখতে পাওনি। এইতো গেল। দেখ দেখ কত খাবার দাবার জিনিসপত্র আনাজ সবজি। কাপড় চোপড় এনেছে। তুমি তো আগে এত আনতে না।” কথার উত্তর না পেয়ে গৃহিনী গীতা পান্ডার দিকে তাকায়। দেখেন গীতা পান্ডা অঝোর ধারায় কাঁদছেন। গৃহিনী উঠে এসে সামনে বসে আবার বলেন,— “জানো তো ওদের কিছু কিছু খেতে বললাম, তা ফর্সা ছেলেটি বলে-না আমি খেয়েই এসেছি। কালো ছেলেটিকে দেখিয়ে বলে, —ও কিছু খেতে পারেনি। ওর জিভ কেটে গেছে ,আ-হা-রে। কিছু খেলো না “। গৃহিণীর কথা শেষ হবার আগেই গীতা পান্ডা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে,—” আরে, তুমি অমন করে কাঁদছো কেন?”
“ওরা আসতেই তুমি আমায় ডাকলে না কেন? আমার এত কপাল খারাপ যে আমায় কাল ঘুমে পেয়েছিল। হায় হায়, হে প্রভু তুমি আমার ঘরে এসেও আমি তোমার দেখা পেলাম না”।— “কি বলছো তুমি,তোমার কি মাথা খারাপ হলো,”—” গিন্নি -তুমি চিনতে পারোনি। ওরা আমার জগন্নাথ বলরাম,আমার মহাপ্রভু।”
—-“মানে —।” চমকে ওঠেন গৃহিনী।
—হ্যাঁ , তুমি আমার গীতা ছেড়াতে মহাপ্রভুর জিভ কেটে গেছে, তাই উনি কথা বলতে পারছেন না, আর অপরজন হলেন শ্রী বলরাম ।”
—-“এসব কি বলছো?”—-“হাঁ। গীতা শ্লোকই তো ওনার মুখনিঃসৃতবাণী। গীতার পাতা ছেঁড়া মানে ওনার জিহ্বা কেটে যাওয়া। হায় হায় , একটু থেমে আবার বলেন গীতা পান্ডা ,—” ঐ রকম কিশোর মন্দিরে থাকে না , আর এত জিনিস খাবার দাবার আমার মতো দ্বিতীয় শ্রেণীর পান্ডারা কেউ পায় না।”
সব শুনে গীতা পান্ডার গৃহিণীও কাঁদতে লাগে। আর বলেন, —-“হে ঈশ্বর আমি কি পাপ করেছি, কত বড়ো অন্যায় করেছি, আমায় ক্ষমা করো প্রভু।”
গীতা পান্ডা তাঁর ছেঁড়া গীতার পাতা ভালো করে জুড়তে বসেন। আর অবিরল ধারায় কেঁদে যান। ভক্তের ব্যাথা ভগবান উপশম করেন।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Kaberi Ghosh |
Narrator | Debanshu Ghosh |
Introduction | Priyanka Dutta |
Characters | Name |
---|---|
Gita Panda & Baloram | Joydeep Lahiri |
Gita Panda Wife | Susmita Ghosh |
https://www.facebook.com/srijoni
khub sundor, mon chuye gelo.
Joy Jagannath. Golpota khub sundor.
সুন্দর গল্প। একরাশ ভালো লাগা।
বেশ গল্প।