Visits: 21

ভাইফোঁটা (Part -2):

  – “উঃ মাগো” –

চমকে ওঠে অর্পিতা। সামনে বাগানের গেটে তার চোখ যায়। একটা কিশোর পড়ে কাতরাচ্ছে। ছুটে যায় সে গেটের কাছে। আস্তে আস্তে ধরে তোলে কিশোরটিকে। কপালটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। 

কপালের দিকে তাকিয়ে বলে অর্পিতা – “ইস অনেকটা কেটে গেছে। এসো ভিতরে এসো।”

কিশোরটিকে সঙ্গে করে বারান্দায় এসে বসতে বলে ঘরে যায় অর্পিতা। ডেটল, তুলো, ওষুধ, পরিষ্কার একখন্ড ফালি কাপড় নিয়ে আসে। কিশোর ছেলেটি এতক্ষণ কপালটা চেপে বসে ছিল। অর্পিতা ওর কাছে বসে রক্ত মুছিয়ে দিয়ে তুলো দিয়ে ওষুধ দিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দেয়। 

এবার এতক্ষনে তার মনে আসে, ছেলেটি কে? – কেন এখানে এসেছিলো? ভালো করে মুখের দিকে তাকায়। সরল নিষ্পাপ একটা মুখ। বড় বড় দুটি চোখ, জলে ভরা যন্ত্রনা মাখা। মুখখানা দেখলে বড় মায়া হয়। 

– “কে তুমি? এখানে কি দরকার।” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অর্পিতা। 

– “আমি নন্দ।” একটু থেকে নন্দ কাচুমাচু হয়ে বলে – “আমি একটু জল খাবো দিদিভাই।”

– “ও – হ্যাঁ -হ্যাঁ দিচ্ছি।” থমকে যায় অর্পিতা কি বললো – “নন্দ, দিদিভাই” কতদিন পর ঐ ডাকটা শুনলো সে। 

নন্দ আবার বলে – “দিদিভাই একটু জল-” 

স্তম্ভিত ফিরে পায় অর্পিতা ঘরে গিয়ে এক গ্লাস জল এনে দেয় নন্দকে। 

এক নিঃশ্বাসে জলটুকু খেয়ে নন্দ বলে, – “ঐ যে সীমা দি, ওষুধের দোকানে গিয়ে এই ওষুধ গুলো কিনে, আমায় বলল, নন্দ ভাই তুমি আমাদের পাশের কোয়াটারে অর্পিতা দি কে এই ওষুধ গুলো দিয়ে আসবে? আমরা অন্য জায়গায় যাচ্ছি তো ফিরতে দেরি হবে। অর্পিতা দির খুব মাথার যন্ত্রনা হচ্ছে।’ আমি বললাম, হ্যাঁ যাবো আমি দিদি কে চিনি।” একটু থেমে নন্দ বলে – “আমার আসতে দেরি হয়ে গেল। তাই ছুটে ছুটে আসছিলাম। এখানে এসে এতো জোরে হোঁচট খেলাম যে পড়ে গেলাম।”

অর্পিতা ওর হাত থেকে ওষুধ গুলো নিয়ে বলল – “তুমি ওই দোকানে কাজ করো বুঝি।”

– “হ্যাঁ দিদি ওখানে কাজ করি।”

– “তোমার কে আছেন? বাড়ি কোথায়?”

মাথা নিচু করে নন্দ বলে, – “আমার কেউ নেই দিদি, বাড়িও নেই। ঐ দোকানে কাজের বদলে দুবেলা খেতে দেয় আর থাকতে দেয়।”

থমকে যায় অর্পিতা। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে – “কোথায় থাকতে দেয় ঐ দোকানেই?”

– “হ্যাঁ, রাতে ঐ দোকান ঘরেই থাকি। সকালে দোকান খুলে ঝাড়পোঁছ করি। এটা সেটা ফাইফরমাশ খাটি।”

– “যেদিন দোকান বন্ধ থাকে সেদিন কোথায় থাকো?”

– “সেদিন ঐ দোকানের মালিকের বাড়িতে কাজ করি।”

কথা বলতে বলতে খেয়াল নেই কারো যে রাত অনেক হয়েছে। হঠাৎ খেয়াল হয় নন্দর – “ওঃ অনেক রাত হয়ে গেছে দিদি। আমি যাই।” উঠে দাঁড়ায় নন্দ মাথাটা ঝিমঝিম করছে। 

অর্পিতা বলে – “যেতে পারবে তো ?”

– “হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিক চলে যাবো।” চলে যায় নন্দ। নন্দর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে অর্পিতা।  আনন্দ আজ থাকলে এরই মত হত বছর ১৩/১৪, একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক কাঁপিয়ে।

অর্পিতা স্কুল সকাল ৭টায়। প্রাতঃরাশ সেরে, তৈরী হয়ে সাড়ে ছটায় বেরিয়ে পরে সে স্কুল পথে। মোড়ের মাথায় ওষুধের দোকানের কাছে ছোটখাটো একটা ভীড় দেখে কৈতুহলে এগিয়ে যায় সে ভীড়ের দিকে। নন্দ ঐ দোকানেই তো কাজ করে। আজ বৃহস্পতিবার ওষুধের দোকান বন্ধ। তবে ভীড় কিসের? একটু উঁকি দিয়ে দেখে, নন্দ পড়ে আছে মাটিতে কাৎ হয়ে। মাথায় মুখে রক্তের দাগ। বেহুঁস অবস্থায় পড়ে আছে। পাশের দোকানের একটি ছেলে বলে কাল না বলে কোথায় গিয়েছিল, তাই মালিক ওকে মেরে দোকান বন্ধ করে চাবি নিয়ে চলে গেছে। ভীড় ঠেলে অর্পিতা ছুটে যায় নন্দর কাছে। বসে ওর মাথায় হাত দিয়ে ডাকে ‘নন্দ’, কিন্তু চম্কে ওঠে সে উঃ জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কার্ত্তিক মাসে হিমের মধ্যে সারা রাত বাইরে শুয়ে। 

একটা রিক্সা ডেকে অর্পিতা একজনের সাহায্যে নন্দর অচৈতন্য দেহটাকে আঁকড়ে রিক্সায় বসে। পাশের দোকানের ছেলেটি বলে, – “একি ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

অর্পিতা ধীর গলায় বলে, – “ও আমার হারিয়ে যাওয়া ভাই। দোকানের মালিককে বলো ও আর এখানে কাজ করবে না।”

   নন্দকে এক ডাক্তার দেখিয়ে কোয়াটারে ফিরে আসে অর্পিতা। স্কুলে যাওয়া হল না। পরের দিন নন্দর জ্বর কমে। চোখ মেলে তাকায় সে। অর্পিতাকে দেখে ধরমর করে উঠে বসে। অর্পিতা তাড়াতাড়ি ওকে ধরে বলে, – “না না উঠিস না ভাই। তোর শরীর খারাপ।”

– “কিন্তু দিদি আমি -।”

– “তুই আমার ঘরে আমার কাছে।” 

– চোখে জল আসে নন্দর। গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে অর্পিতা ওর মাথাটা বুকের মাঝে চেপে ধরে বলে। “কাঁদিস না ভাই। তুই যে আমার হারিয়ে যাওয়া আনন্দ, আর আমি তোর দিদিভাই।” 

নন্দর আবেগের সঙ্গে বলে – “কাল ভাইফোঁটা আমায় ভাইফোঁটা দেবে দিদিভাই?”

– “হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চই দেবোরে। তুই আমার ভাই তোকে ফোঁটা দেবো না। আমি আজই সব জোগার করে আনবো।”

   পরের দিন অর্পিতা সকাল সকাল স্নান সেরে, নন্দকে নতুন জামা পড়িয়ে আসতে আসতে আসনে বাসায়। মিষ্টির থালা সামনে রাখে প্রদীপ জ্বেলে দেয়। চুরা চন্দন আর দই -এর ফোঁটা কপালে দিয়ে বলে, – “ভাই -এর কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।” ………..

   প্রদীপের নরম আলোয় দুজনের চোখের জল চিকচিক করে ওঠে। আর মুখে ফোটে আনন্দের হাসি। 

https://www.facebook.com/srijoni

What’s your Reaction?
+1
0
+1
1
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

About Post Author

6 thoughts on “ভাইফোঁটা (Part -2)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *