প্রিয়াঞ্জলি
![প্রিয়াঞ্জলি প্রিয়াঞ্জলি](https://srijoni.co.in/wp-content/uploads/2023/06/priyanjali-1st-part-story-debanshu-ghosh-srijoni.jpg)
Views: 66
প্রিয়াঞ্জলি:
‘কলকাতা’ এই একটা শব্দতেই জড়িয়ে আছে বহু গল্প, বহু ইতিহাস, বহু সাহিত্য যা আমাদের মনকে নস্টালজিক করে তোলে, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ‘কলকাতা’ বলতেই প্রথম যে কথাটা মাথায় আসত তা হল ‘মহানগরী’। প্রথম কলকাতাতে আসার একটা অদ্ভুত অনুভূতি প্রত্যেকটি বাঙালি হৃদয়ে আজও স্মৃতি মধুর। কলকাতা যেন স্বপ্নের নগরী, যেখানে অপূর্ণ সব স্বপ্ন পূর্ণ হয়। কারণ মানুষ যখন ছোট থাকে তাদের বহু চাহিদা থাকে, সেই চাহিদাগুলোও কিন্তু পূরণ করে এই মহানগরী কলকাতা, মহানগরীর এই স্বপ্নের নগরীতে পরিবর্তিত হওয়ার যে প্রয়াস তা ছড়িয়ে পড়েছে তার কর্মক্ষেত্রগুলির মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন শহরতলীতে। তাই এই স্বপ্ন নগরীর সঙ্গে প্রত্যেক মানুষই ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই মহানগরীরই একটি ছোট্ট প্রেমের গল্প আজ আপনাদের বলব।
সময়টা খুব পুরোনো নয়, নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সবারই ইচ্ছা থাকে যে তার নতুন নতুন বন্ধু হবে । রাঘবেরও এমনই ইচ্ছা ছিল। রাঘবও H.S. পরীক্ষায় পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছে। নতুন কলেজে ভর্তি হয়ে তার যেমন আনন্দ হচ্ছিল তেমন ভয়ও করছিল। রাঘব এতদিন শুনেছে কিন্তু এই প্রথম অনুভব করল যে মিশ্র অনুভুতি কাকে বলে। রাঘব কলকাতার হাতিবাগানের ছেলে হলেও তার মধ্যে মফস্বলের একটি ছাপ স্বষ্ট লক্ষ্য করা যেত। তাই সে ভাবত কলেজে তার কী কোন বন্ধু হবে, কারণ সে অতি আধুনিক নয়।রাঘবের স্বভাবে এই মফস্বলের ছাপ থাকার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। রাঘব শৈশব অধিক সময়ই কাটিয়েছে তার মামারবাড়ি বর্ধমানে। গ্রামে বাড়ি হলেও রাঘবের মামারবাড়ি ছিল অতি সম্ভ্রান্ত ও সমৃদ্ধশালী। রাঘবের মা রাঘবের বাবাকে ভালোবেসে বিয়ে করে কলকাতায় চলে আসে । রাঘবের দাদু এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন নি, আর তাছাড়া রাঘবের বাবার রোজগারও তেমন ছিল না। তিনি মেয়েকে বলেছিলেন,
-“তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছো যে ছেলেটিকে বিয়ে করবে তখন আমার অনুমতি নেওয়ার তো কোনো দরকার নেই।”
কিন্তু যা হয় নাতি-নাতনি জন্মালেই কঠোর পিতা তাঁর কন্যাকে মেনে নেন। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। রাঘব জন্ম নেওয়ার পরই তার দাদু মেয়ে জামাইকে মেনে নেন এবং রাঘবকেও তার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখেন।
তিনি বলেন,
-“ওই শহরে আমি আমার দাদুভাইকে মানুষ হতে দেব না। ও আমার কাছে থেকেই মানুষ হবে এই আমার শেষ কথা ব্যাস।”
রাঘবের কোন অভাব রাখেনি তার দাদু। না পড়াশোনা, না অন্যকিছু। তিনি রাঘবকে বড়ো স্কুলে ভর্তি করে দেন এবং রাঘবও মাধ্যমিক পাশ করে দেখতে দেখতে। মাধ্যমিক পরীক্ষা বর্ধমান থেকে দিলেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় কিন্তু কলকাতা থেকেই। মাধ্যমিক পরীক্ষার সে ভালো নম্বর পেয়েছিল। তার ইচ্ছা ছিল সে আর্টসের ইতিহাস বিষয়টি নিয়ে পড়বে, কারণ ইতিহাস পড়তে রাঘবের খুবই ভালো লাগত। কিন্তু তাবলে যে রাঘব সায়েন্সে খারাপ ছিল এমনটা ভাবার কিন্তু কোন কারণ নেই। তাই কিছুটা জেদের বশেই সে কলকাতা শহরে চলে আসে কারণ রাঘবের ইচ্ছা ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো বড়ো কলেজে অ্যাডমিশন নিয়ে সে পড়াশোনা করবে। রাঘবের এই সিদ্ধান্তে রাঘবের দাদু বাধা দেননি। রাঘবের পরিবারের আর্থিক অনটন এতদিনে ঠিক হয়ে এলেও রাঘবের সমস্ত খরচ তাঁর দাদুই বহন করতেন। এতে রাঘবের মা, বাবা কোনদিন আপত্তি করেননি বা করলেও রাঘবের দাদু শুনতেন বলে মনে হয় না ।
যাইহোক রাঘব H.S. পরীক্ষোতেও Arts stream নিয়ে খুব ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে । পাশ করার পর রাঘব প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির জন্য Form fill-up করে। তখন কিন্তু এখনকার মতো এ বাড়িতে বসে বসে সব কাজ online -এ করা যেত না। তখন রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে একটা কলেজে ভর্তি হতে হতো, যার ফলে অনেক বন্ধু বান্ধবও তৈরী হত।
প্রথম যেদিন রাঘব কলেজের চৌকাঠটা পেরোলো, সেদিন রাঘবের একটা কথাই মাথায় এসেছিল।
-‘‘আচ্ছা আমি যেদিন ফর্ম জমা দিতে কলেজে এসেছিলাম, লাইনে আমার আগে একটা মেয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার সাথে কী আর আমার দেখা হবে? সেদিন তো জিজ্ঞাসা করা হল না যে মেয়েটা কোন stream-এ ভর্তি হয়েছে? আর্টস, সায়েন্স নাকি কমার্স! কথা অনেকই হয়েছিল, শুধু এটুকুই জেনেছিলাম। সে Bio Science নিয়ে পড়েছিল, তাই কমার্সে পড়ার কোন সুযোগ নেই, Science-এর কোন বিষয়ে ভর্তি হয়েছে হয়তো? বন্ধুত্ব তো হতেই পারে তাই না। কিন্তু দেখা হলে তবেই না বন্ধুত্ব হবে।’’
এইসব ভাবতে ভাবতেই রাঘব ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। লিস্টে ক্লাস রুম দেখে, অবশেষে নির্দিষ্ট ক্লাসে গিয়ে বসল রাঘব। তখনও পর্যন্ত সকলে এসে পৌঁছায়নি । কয়েকজন বসে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউ কেউ একা বসে আছে আবার কেউ কেউ দল বেঁধে বসে আছে। হঠাৎই রাঘব সেই মেয়েটাকে বাইরে দেখতে পেল। রাঘব কী করবে এটা ভাবতে ভাবতেই দু-তিন মিনিট কেটে গেল এবং তারপর যান্ত্রিক মানবের মতো হেঁটে বাইরে বেড়িয়ে গেল। কিন্তু কই? মেয়েটাকে তো আর দেখতে পেল না। মেয়েটা কি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল, নাকি রাঘব ভুল দেখল? অগত্যা আবার ক্লাসে এসে বসল। ধীরে ধীরে ঘর ভর্তি হয়ে এল এবং Professor এসে ক্লাস শুরু করলেন।
৪০মিনিট এর ক্লাস শেষ হবার পর রাঘব যখন বাইরে এল তখন কলেজ চত্বর মোটামুটি ফাঁকা। শুধুমাত্র প্রতিটা ক্লাস থেকে কিছু কিছু ছেলে মেয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওই মেয়েটাকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল মেয়েটা? রাঘব অনেক চেষ্টা করেও নামটা মনে করতে পারল না মেয়েটার। কী যেন নাম ছিল মেয়েটার খুবই আনকমন নাম। চট্ করে এমন নাম শোনা যায় না। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাঘব পরবর্তী ক্লাসের জন্য আবার রূমে এসে বসল। হয়তো নবীনবরণ-এর দিন মেয়েটার সঙ্গে দেখা হবে রাঘবের।
যাইহোক রাঘবের কলেজের প্রথম ক্লাসটা কিন্তু ইতিহাসের ছিল না। একটা জেনারেলের ক্লাস ছিল। হঠাৎ করেই রাঘবের মনে মনে বললো,
-‘‘এইটা তো আমাদের Arts-এর Building, যদি মেয়েটা এখানে ঘোরাঘুরি করে তাহলে কী মেয়েটা Arts-এর কোন Subject-এ ভর্তি হয়েছে? অন্য কোনো Arts -এর Subject-এ ভর্তি হয়েছে কী? হতেই পারে?’’
এই কথাটা প্রমানিত হল না ঠিকই কিন্তু রাঘবের মনটা আনন্দে ভরে উঠল, মনে মনে রাঘব ভাবল,
-‘‘এই কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কতই না ভালো হবে। ওর সাথে কথা বলতে পারব, বন্ধুত্বও হবে? আর… না থাক আর কিছু না।’’
এরপর ঘন্টা পরল নতুন ক্লাস শুরু হবে বলে। নতুন ক্লাসে নতুন Professor ক্লাস নিলেন। ইনি একজন ম্যাডাম। নতুন ম্যাডাম বাংলা ক্লাস নিয়ে চলে গেলেন নির্দিষ্ট সময়ে। রাঘব ভাবল,
-“এই ক্লাসটাও তো শেষ হয়ে গেল, কই মেয়েটাকে তো দেখতে পেলাম না।”
এরপর কলেজে যা হয় -এর কিছু ছেলে মেয়েরা রাঘবদের ক্লাস-এ এলো এবং নতুন স্টুডেন্টদের সাথে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আলাপ করল। রাঘবকেও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করল,
-‘‘তোমার নাম কী?’’
রাঘব নির্ভয়ে বলল,
-‘‘আমার নাম রাঘব ব্যানার্জী।’’
‘‘আচ্ছা, কোথায় বাড়ি তোমার?’’
-“হাতিবাগানে”
-‘‘আচ্ছা’’
এমন নানা কথপকথনের পর তারা রাঘবের থেকে একটা সই চাইল এবং বলল,
-‘‘রাঘব আমরা সব নতুন স্টুডেন্টদের থেকেই নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর নিচ্ছি। কোনো জোড় জবরদস্তি নেই, তোমার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার নাম এই কাগজে লিখতে পার।’’
রাঘব অত কিছু না ভেবেই খাতায় নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লিখে দিল। ফোন নম্বরটা লেখার সময় রাঘব দেখল তার নামের তিন-চার জনের আগে একটা নাম দেখে রাঘবের চেনা চেনা লাগল। কোথায় জেনো নামটা শুনেছে, নামটা হল ‘‘প্রিয়াঞ্জলি’’। ‘প্রিয়াঞ্জলি ঘোষ’ অনেকক্ষণ ধরে নামটা মনে করার পর হঠাৎই মনে পড়ে গেল, আরে এতো সেই মেয়েটারই নাম মনে হয়। কিন্তু Surname টা কিছুতেই মনে পড়ছে না। কৌতুহল সামলাতে না পেরে Union-এর দাদাটাকে রাঘব জিজ্ঞাসা করে ফেলল,
-‘‘দাদা এই নামের মেয়েটা কোন Stream-এর? আর কোন রুমে বসেছে?”
হঠাৎ করে এই প্রশ্নটা শোনার পর -এর ছেলেটিও হকচকিয়ে যায়। সে বলল, -“কেন? তোমার পরিচিত।”
রাঘব উত্তরে বলল,
-“হ্যাঁ দাদা ও আমার পরিচিত। কিন্তু কলেজে আসার পর আর খুঁজে পাচ্ছি না।”
রাঘবকে একটু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। রাঘবের মনের ভাব সে চেপে রাখার চেষ্টা করে। Union-এর ছেলেটি উত্তর দেয়,
-“হ্যাঁ এই ব্যালকনির শেষের যে রুমগুলো, সেখান থেকেই আমরা আসছি। হতে পারে এই মেয়েটা ওই রুমগুলোর মধ্যেই কোন একটা রুমে বসেছে।’’
কথাটা শোনার পর রাঘবের মনে আশার আলো জাগে এই ভেবে যে মেয়েটাকে হয়তো রাঘব খুঁজে পেয়ে যাবে। কিন্তু আবার মনে সংশয় ও জাগে এই ভেবে যে ,
-“এই মেয়েটা যদি সেই মেয়েটা না হয়, কারণ একই নাম তো দুজনেরও হতে পারে?”
কিন্তু রাঘব এখন কোন negative কথা ভাবতে চায় না। রাঘবের কেন জানি মনে হতে লাগে এই নামটা মেয়েটারই হবে। হ্যাঁ Surname-টা রাঘবের মনে নেই ঠিকই কিন্তু তাও মনে হতে লাগল এই সে। Union- এর দাদারা চলে গেলে রাঘব এক দৌড়ে ক্লাসের বাইরে আসে এবং ব্যালকনি পেড়িয়ে ছুটতে ছুটতে,একজনকে প্রায় ধাক্কা মারতে মারতেও বেঁচে গিয়ে ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু একি! ঘরে তো কেউ নেই, ঘর তো ফাঁকা। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ঘরের নম্বর ২৩।
‘‘কিন্তু দাদাটা যে বলল এই ঘরেই ছিল মেয়েটা? তাহলে কী ছুটি হয়ে গেছে? ইশ্! কালকে মেয়েটা আসবে তো? নিশ্চয়ই আসবে, মেয়েটাকে খুঁজে পেতেই হবে। কিন্তু এবাবা ওই খাতায় ফোন নম্বর-ও তো ছিল, যদি নম্বরটা পাওয়া যেত? কিন্তু ফোন করেই বা কি হবে? ও কি আমাকে মনে রেখেছে, যে আমি নাম বললেই কি আমাকে চিনতে পারবে? কিন্তু তাও তো চেষ্টা করে দেখা যেত।’’
খুব ভুল করে ফেলেছে রাঘব, নিজের মাথাতেই চাঁটি মেরে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আবার ক্লাসরুমের দিকে ফিরে এসে শুনল আজকের মতো সমস্ত ক্লাস ছুটি দেওয়া হয়ে গেছে, কারণ নতুন ছাত্রছাত্রীদের আজ কলেজে প্রথম দিন তাই।
কী আর করে রাঘব? আস্তে আস্তে গুটিগুটি পায়ে কলেজের গেটের দিকে পা বাড়াল ঠিকই কিন্তু তার চোখ দুটো যেন শুধু সেই মেয়েটিকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে ……।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Debanshu Ghosh |
Narrator | Souradip Roy |
Introduction | Debanshu Ghosh |
Characters | Name |
---|---|
Raghab | Debanshu Ghosh |
Dadu | Joydeep Lahiri |
College senior | Soumen Sadhukhan |
https://www.facebook.com/srijoni
Osadharon👌