Visits: 116

স্বপ্নের রাজবাড়ী:

আমি U.S.A-তে কর্মরত একজন ভারতীয়। বলতে পারেন এক ছাপোষা বাঙালী ঘরের মেয়ের বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো আমার একটা চাকরি জুটে যায় বিদেশে। আমার এখানে প্রায় তিন বছর হতে চলল। প্রতি মুহূর্তে চলছে আধুনিক জগতের মানুষ হয়ে ওঠার লড়াই। আমার বাবা মা দুজনে কলকাতায় থাকেন ঠাকুমার সাথে।

 আমার ঠাকুমা সুহাসিনী দেবী একজন দৃঢ়চেতা নারী এবং অল্প বয়সে মেয়েদের জন্য অনেক লড়াই করেছেন। তিনি আর আমার দাদু হরিনাথ মুখার্জ্জীর একটি ছোট সংসারের পরবর্তী প্রজন্ম হলাম আমরা। থাক এসব কথা।

আমি যেটা আজ বলব সেটা একটা বাড়ির গল্প। গল্প আমি সেভাবে বলতে পারি না, ঠাকুমা পারত খুব সুন্দর করে গল্প বলতে। আমার বন্ধু র‍্যাচেল ডিসুজা গত মাসে ভারতে গিয়েছিল একটা প্রজেক্টের জন্য কিছু ছবি তুলে আনতে। আমি যখন গতকাল বিকেলে কফি খেতে খেতে ম্যাগাজিন দেখছিলাম তখন র‍্যাচেল আমায় বলল,
-‘‘তানিয়া, তোমার দেশটা খুব সুন্দর জানো!, কি সুন্দর মানুষের ব্যবহার আর পুরনো বাড়িগুলো যেন কতকিছু বলে চলেছে। এই দেখো আমি কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি তুলেছি কিছু পুরানো রাজবাড়ী ও সাহেবদের বাড়ির’’।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
-‘‘তোমাকে আমার খুব হিংসে হয় জানো। আমি ভারতীয় হয়ে নিজের দেশ আর সংস্কৃতিকে প্রায় ভুলতে বসেছি। আর তুমি কি সুন্দর আমার দেশটাকে উপভোগ করে ফিরে এলে, দাও তো দেখি ছবিগুলো।’’
র‍্যাচেল হেসে বলল,
-‘‘হ্যাঁ নিশ্চয়, আচ্ছা তুমি একটা কাজ করো। ছবিগুলো  দেখে আমার ঘরে রেখে দিয়ে এসো। আমি একটু বেরোচ্ছি।’’

র‍্যাচেল চলে যাওয়ার পর ছবিগুলো দেখতে বসে হঠাৎ করে আমাদের পুরনো বাগানবাড়িটার কথা মনে পড়ে গেল। সেই আমবাগান, সেই পুকুর পাড় আর খোলা আকাশের নীচে একফালি উঠোন যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো সাজানো প্রকৃতি দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে। এইসব বসে বসে ভাবছি, হঠাৎ দেখি বাবা ফোন করেছে। তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে বললাম,
-‘‘হ্যাঁ বাবা বলো। ’’
বাবা বলল,
-‘‘কে? রিনি বলছিস তো? আরে দেখ না তোর ঠাকুমার একটা অদ্ভুত আবদারের জন্য তোকে ফোন করলাম। ব্যস্ত আছিস নাকি?’’
আমি বললাম,
-‘‘না না বলো কি বলবে? তোমরা সবাই ঠিক আছো তো?
বাবা বললেন,
-‘‘হ্যাঁ রে মা, আমরা সবাই ঠিক আছি। যেটা বলছিলাম তোর ঠাকুমা চান এবছর আমরা সবাই মিলে স্বপ্নকুঠীতে যাই। শীত আসছে, একটা দিন পিকনিক করলে সবার সাথে খুব মজা হবে। বুঝতেই পারছিস, ঠাকুমার বয়স হয়েছে।’’
আমি বললাম,
-‘‘আচ্ছা দাঁড়াও, চেষ্টা করে দেখি!’’

 বাবা ফোন করার দশ দিন পর দেশে গেলাম। দিল্লীতে পৌঁছে সেখান থেকে কলকাতা এবং তারপর কলকাতা থেকে সোজা কোচবিহার। গন্তব্য ‘স্বপ্নকুঠী।’  বাবারা চলে গেছিল আগের দিন। আমার ফ্লাইট লেট ছিল বলে পরের দিন পৌঁছাই। আপনারা ভাবছেন বাড়ির এরকম নাম কেন? সেটাও খুব মজার। দাদুর ছিল জমিদারি হাবভাব, আর তিনি সবসময় চাইতেন জমিদারদের মতো রাজবাড়ি বানিয়ে সেখানে থাকবেন। কিন্তু আমার ঠাকুমা ছিলেন খুব হিসেবী মানুষ। একটা পয়সা এদিক থেকে ওদিক হওয়ার জো ছিল না।
দাদুদের দশম বিবাহবার্ষিকীতে ঠাকুমাকে দাদু বলেন,
-‘‘আচ্ছা ‘গিন্নী ভগবানের দয়ায় তো আমাদের কিছু অভাব নেই। চলো না একটা রাজবাড়ি বানাই আমাদের মনের মতো করে।’’
সেই শুনে ঠাকুমা বলেন,
-‘‘তোমার ভীমরতিটা দেখছি দিনের পর দিন বাড়ছে। একটা পাগলের ডাক্তার দেখাও। যা শুরু করেছ ছেলেমেয়েদের নিয়ে পথে বসতে হবে দেখছি।’’

দাদু সেই থেকে ঠাকুমাকে আর কিছুই বলেনি। একদিন ঠাকুমা তার ভাই মানে আমাদের সবার প্রিয় বিশু দাদুকে বলেন,
-‘‘হ্যাঁরে বিশু, তুই কি ভালো বাগান বাড়ির খোঁজ জানিস? শহর থেকে দূরে কোথাও। তোর জামাইবাবুর শখ হয়েছে রাজবাড়ী বানিয়ে জমিদার হবে।’’
বিশু দাদু হেসে বললেন,
-‘‘তাহলে বাগান বাড়ি খুঁজছ কেন দিদি?’’
ঠাকুমা বললেন,
-‘‘রাজবাড়ী বানানোর অনেক খরচ। তাছাড়া ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যত আছে। তুই চেষ্টা করে দেখ না যদি খোঁজ পাস।’’

বিশুদাদু তার এক বন্ধু রামলালকে বলে উকিল ডাকিয়ে ঠাকুমাকে এই বাড়িটা পাইয়ে দেয়। ঠাকুমার কিন্তু এসব দাদুর অজান্তে করেছিল। একদিন ঘুরতে যাওয়ার নাম করে দাদুকে ঠাকুমা নিয়ে আসেন এই বাড়িতে।

দাদু বাড়ি দেখে লাফিয়ে উঠে বলেন,
-‘‘দেখেছো গিন্নী বাড়িখানা, উফ! এরকম যদি একটা বাড়ি আর কিছু তলা বানিয়ে একটি বনেদি রাজবাড়ি বানিয়ে ফেলতে পারতাম দেখতে সবাই হাঁ করে এই হরিনাথ মুখুজ্জেকেই দেখত। ’’
ঠাকুমা বললেন,

-‘‘থাক আর ওতো করে কাজ নেই। এই বাড়িটা আমাদেরই। রাজবাড়ী করার শখটা তোমার আর্ধেকটা মিটিয়েছি এই বাড়ি কিনে। এবার এটাই আমরা আমাদের রাজবাড়ী বানিয়ে তুলব।’’দাদু অবাক হয়ে বলেন,
-‘‘গিন্নী তুমি এত কিছু একা একা কি করে করলে? তুমি যে এই বাগানবাড়িখানা আমার জন্য কিনেছো এটাই আমার রাজবাড়ী গো। আমি এই বাড়িটাকেই রাজবাড়ীর মতো সাজিয়ে তুলব দেখবে।’’

তারপর আমরা যখন হই তখন থেকে প্রতি বছর শীতের ছুটিতে ঐ বাড়ি যেতাম আর দাদুর সাথে খেলা করা, মাছ ধরা, গাছে চড়ে ফল পাড়া সবই চলত। ঠাকুমা আমাদের নানারকম রান্নাবান্না করে খাওয়াত, লোডশেডিং হয়ে গেলে গল্প বলত আর যখন ফিরে আসতাম তখন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলত। আসলে বাড়িটা কেনার পর যখন বাবারা সবাই বিয়ে করে সংসার করেছে তখন দাদু আর ঠাকুমা ওই বাড়ি চলে যান। তারপর থেকে ওখানেই থাকত। দুবছর আগে দাদু মারা যায় আর বাবা ঠাকুমাকে কলকাতায় নিয়ে চলে আসে। বাড়িটা একরকম পড়েই ছিল জানেন ধূলোর অন্ধকারে। গতবছর যখন যাই ওখানে দেখি সবকিছু আগের মতোই আছে। ঠাকুমা খালি আগের মতো নেই। শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। ভালো করে চিনতেও পারে না আর কথাও বলতে পারে না। বাবাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম,
-‘‘তুমি তাহলে আমায় ফোন করে আসতে বললে যে এখানে। কিন্তু ঠাকুমা তো আমায় চিনতেই পারছে না।
বাবা বলল,
-‘‘জানি, কিন্তু তুই যদি না আসতিস তাহলে এই বাড়িটীকে আর দেখতে পেতিস না।’’
আমি বললাম,
-‘‘কেন?’’
 মা বলল,
-‘‘তোকে তোর বাবা বলেনি। এই বাড়িটা আমরা বিক্রি করে দিচ্ছি। শুধু শুধু ধূলো জমে থাকার থেকে অন্তত কারোর কাজে লাগুক।’’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। সেদিন আর কারোর সাথে কথা বলিনি। শুধু ভাবছিলাম যে দুটো মানুষ নিজেদের ভালোবাসা দিয়ে এই বাড়িটা সাজিয়েছিল হারিয়ে যাবে? এই বাড়িটা তো শুধু বাড়ি ছিল না। আমাদের ছোটোবেলার হাজারটা খুনসুটি আর দাদু ঠাকুমার ভালবাসার নীড় ছিল। মানুষ চলে যাওয়ার সময় হয়ে এলে হয়তো আর ব্যবহার করা জিনিসটাও তুচ্ছ মনে হয়।

ফোনে অ্যালার্ম বেজে উঠল,দেখলাম সন্ধ্যা ৬টা। মনে পড়ে গেলো একটা মিটিং আছে। তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলাম রেডী হতে।

Audio Story Starts From Here:

Story InfoName
WriterTrisha Laha
NarratorPriyanka Dutta
IntroductionOlivia Das
CharactersName
TaniaPriyanka Dutta
David & BabaDebanshu Ghosh
Suhasini debi & MaaOlivia Das
Thakur daJoydeep Lahiri
Bisu daduSouradip Roy

https://www.facebook.com/srijoni

আরো পড়ুন

What’s your Reaction?
+1
0
+1
3
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *