প্রিয়াঞ্জলী -অন্তিম পর্ব
Views: 42
প্রিয়াঞ্জলী -অন্তিম পর্ব:
রাঘব কলেজ থেকে ফিরে বাড়িতে এসেও ভাবতে থাকে প্রিয়াঞ্জলীর কথা, রাঘবের অন্যমনস্কতা দেখে রাঘবের মা ওকে জিজ্ঞাসা করে –
– “কিরে বাবু কলেজের প্রথম দিন কেমন কাটল বললি না তো?”
রাঘব অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয়,
– “হ্যাঁ, ভালোই মা।”
– “শুধু ভালোই? কটা বন্ধু হলো? আর তুই এত অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছিস কেন? কিছু কী হয়েছে?
রাঘব এড়িয়ে যায় প্রশ্নটাকে, রাঘব বলে –
– “কই কী আবার হবে? কিছু হয়নি তো, তুমি কী রান্না করেছ মা? খুব খিদে পেয়েছে। খেতে দাও, আমি হয়ে আসছি।”
পরের দিন সকালে রাঘব সময়ের আগেই কলেজে পৌঁছে গেল, উদ্দেশ্য প্রিয়াঞ্জলীকে খুঁজে বের করে, তার সাথে বন্ধুত্ব করবে। মাঝে মাঝে রাঘবের মনে হতে লাগল, সেকি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। কিন্তু বাড়াবাড়ির কী আছে বন্ধুত্ব করাটা কী অপরাধ। কিন্তু কই একটার পর একটা ক্লাস হয়ে গেলো, কিন্তু প্রিয়াঞ্জলীকে তো দেখতে পেলো না। আর তাছাড়া রাঘব ২৩ নম্বর রুমের সামনেও বেশ কয়েকবার ঘুরে এসেছে, সেখানেও তো দেখা পেলো না। তবে কী সত্যিই প্রিয়াঞ্জলী এই কলেজে ভর্তি হয়নি?
রাঘব এত ভুল দেখবে? মনমরা হয়ে ক্লাসে ফিরে এল এবং ভালো খবর শুনতে পেল। আগামীকাল রাঘবদের কলেজে। অর্থাৎ নবীকরণ। সব নতুন ছাত্রছাত্রীদের আগামীকাল কলেজ থেকে বরণ করা হবে। খবরটা শুনে রাঘবের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। খুশির কারণ একটাই, কালকে তবে নিশ্চয়ই দেখা হবে প্রিয়াঞ্জলীর সঙ্গে।
আজ নবীকরণ। সব ছাত্ররা আজ পাঞ্জাবী এবং সব ছাত্রীরা আজ শাড়ী পড়ে এসেছে। রাঘবও পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে। সিনিয়র দাদা দিদিদের কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর নতুন ছাত্রছাত্রীদের বরণ করা হবে। আজ কলেজে বেশ ভিড়। এত ভিড়ের মধ্যেও রাঘবের চোখ শুধু একজনকেই খুঁজছে। “প্রিয়াঞ্জলী”, না খুঁজে পেল না তাকে। ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠান শুরু হল। অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে সিনিয়র এক দিদি মাইকে বললেন,
– “নতুন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা যারা এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চাও তারা এসে যোগ দিতে পার।”
অর্থাৎ যারা গান, নাচ, আবৃত্তি পারে তারাও অনুষ্ঠানে তা করতে পারে। কিন্তু রাঘব কী করবে, কারণ রাঘব তো কিছুই পারে না। যাইহোক বেশ কয়েকজন হাত তুলল এবং একের পর এক কর্মসূচী হতে লাগল। রাঘবের ভালো লাগছিল অনুষ্ঠান দেখতে। হটাৎই রাঘব দেখল একটা মেয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে চলেছে। মেয়েটা স্টেজে উঠে মাইকের সামনে আসতেই রাঘব চমকে উঠল। মেয়েটা নীল শাড়ী পড়েছে। দোহারা চেহারা। কাঁধ অবধি চুল পিঠে পড়েছে। চুল বাধা নয় খোলা। মেয়েটার চোখ দুটো টানা টানা। তাতে কাজল পরা ও কপালে একটা ছোট টিপ।
মেয়েটার নাম প্রিয়াঞ্জলী ঘোষ। রাঘব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এও কি সম্ভব। রাঘব প্রিয়াঞ্জলীর দিক থেকে চোখ সরাতে পারল না। কী অপূর্ব দেখতে লাগছে আজকে শাড়ী পড়ে, প্রিয়াঞ্জলীকে। প্রিয়াঞ্জলী গান করল। একটা রবীন্দ্রসংগীত। গানের শেষে সব নতুন ছাত্রছাত্রীকে স্টেজে ডেকে বরণ করা হল। বরণ শেষ হলে রাঘব গেটের দিকে দৌড়ালো। আজ তাকে প্রিয়াঞ্জলীর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। কিন্তু না? এতো ভিড় আজ কলেজে যে গেট অবধি পৌঁছে দেখল প্রিয়াঞ্জলী ততক্ষনে বাসে করে বেরিয়ে গেছে। পরের দিন আবার কলেজে এসে দেখতে পেল রাঘব প্রিয়াঞ্জলীকে কিন্তু রাঘব অনেক চেষ্টা করেও কথা বলতে পারল না। সুযোগও পেয়েছিল রাঘব, কিন্তু প্রিয়াঞ্জলীর সামনে গিয়েও রাঘব কোন কথা বলতে পারে না। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
কিন্তু এইরকম আর বেশী দিন চলল না। রাঘব টিফিনের সময় একদিন ক্যান্টিনে বসে আছে, হটাৎই দেখল প্রিয়াঞ্জলী তার উল্টো দিকের একটা টেবিলে বসে আছে আর তার বান্ধবীদের সঙ্গে বসে গল্প করছে। আজ প্রিয়াঞ্জলী একটা হলুদ রঙের চুড়িদার পড়ে এসেছে। দুপুরের হালকা রোদ জানালা দিয়ে মুখে এসে পড়ছে । রাঘবের মনে হল প্রিয়াঞ্জলীকে রাঘব অনেক আগে থেকে চেনে, প্রিয়াঞ্জলী তার আত্মার আত্মীয় এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাঘব খেয়ালই করেনি প্রিয়াঞ্জলী কখন তার টেবিলে এসে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। রাঘব তো ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। কী বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। নিরাবতা ভাঙল প্রিয়াঞ্জলীর কথাতে। প্রিয়াঞ্জলী রাঘবকে বলল,
– “তোমার নামটাই সেদিন জানা হয়নি,
তোমার নাম?”
-“আমি রাঘব, রাঘব ব্যানার্জী।”
-“আর আমি প্রিয়াঞ্জলী, প্রিয়াঞ্জলী ঘোষ।”
-হ্যাঁ, আমি তোমার নাম জানি।”
-“কি ভাবে জানলে তুমি? আমি তো তোমাকে নাম বলিনি?”
রাঘব একটু থতমত খেয়ে বলল,
-” না মানে সেদিন নবীনবারণে তুমি গান করলে, সেদিনই তো তোমার নাম বলা হলো তাই তো জানতে পারলাম।”
-“ও আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে আমি এখন যাই, আমার Practical Class আছে।”
রাঘব কি বলবে ভেবে পেলো না। শুধু বলল,
-“আচ্ছা। আর বলছিলাম কি! আমি কি তোমার বন্ধু হতে পারি?”
প্রিয়াঞ্জলি অল্প হেসে বললো,
-“হ্যাঁ নিশ্চই।”
ব্যাস এই ছিল রাঘব আর প্রিয়াঞ্জলীর প্রথম আলাপ। তারপর থেকেই ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো দুজনে। দুজনে দুজনের বাড়িতে যাতায়াতও করতো। সব কথা দুজন দুজনের সাথে ভাগ করে নিতো। এইভাবেই ভালো মন্দের মধ্যে দিয়েই কলেজের তিনটে বছর কেটে গেল। ফাইনাল পরীক্ষার আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। রাঘব আর প্রিয়াঞ্জলী তাদের নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। রাঘব আর প্রিয়াঞ্জলী তাই এখন কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্ত।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর রাঘবকে প্রিয়াঞ্জলী ফোন করে বলল,
-“শোন্ রাঘব একবার দেখা করবি?একটা খবর দেওয়ার আছে তোকে , যতক্ষণ না তোকে বলতে পারছি আমার শান্তি হচ্ছে না। আর তাছাড়া এখন তো পরীক্ষাও শেষ, চল না দেখা করি। “
ফোনের ওপর থেকে উত্তর এলো,
-“হ্যাঁ দেখা করাই যায়। এই কি কথা রে?”
-“উফ!! দেখা হলে বলব।”
-“ঠিক আছে আমিও তবে সেদিন তোকে একটা কথা বলবো।”
-“তোর আবার কি কথা।”
-“আমিও দেখা হলেই বলব। এবার বল কোথায় দেখা করবি।”
-“কোথায় আবার কলেজ স্কোয়ারে। পরশুদিন ঠিক বিকাল ৫টার সময় বুঝলি। দেরি করবি না।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
রাঘবের ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। কারণ প্রিয়াঞ্জলীকে সেদিন রাঘব নিজের মনের কথা বলতে পারবে। এতদিন যা বলতে পারেনি। প্রিয়ঞ্জলিকে রাঘব বলে দেবে যে কলেজের প্রথম দিন থেকে শুধু প্রিয়ঞ্জলীকেই সে ভালোবেসেছে। একদিনের জন্য তাকে না ভালোবেসে থাকতে পারেনি।
আজ প্রিয়ঞ্জলির সঙ্গে দেখা করবে রাঘব। সময়ের অনেক আগে বেরিয়ে পড়লো এই ভেবে যদি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। কিনলো এক গুচ্ছ লাল গোলাপ আর একটা জীবনানন্দ দাসের কবিতার বই। কবিতার বই আর গোলাপ প্রিয়াঞ্জলীর খুব পছন্দ। রাঘব আজ সেই হলুদ পাঞ্জাবিটা পড়েছে। যেটা নবীনবরনের দিন পড়েছিল আর কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ। কবিতার বইটা হাতে নিয়ে ফুলগুলো ব্যাগে ভোরে রাখলো।
কিছুক্ষন বাদে প্রিয়ঞ্জলী এলো। খুব খুশি দেখাচ্ছে আজকে তাকে। প্রিয়াঞ্জলীও সেই নীল শাড়ীটা পড়েছে, যেটা সে নবীনবরণ দিন পড়েছিল। চুল খোলা, ছোট্ট টিপ কপালে, চোখে কাজল আর হালকা লিপস্টিক। রাঘব প্রিয়ঞ্জলিকে দেখে চোখ ফেরাতে পারলো না। তাই দেখে প্রিয়াঞ্জলী রাঘবকে বলল,
-“এই রাঘব কি ক্যাবলার মতো তাকিয়ে রয়েছিস।”
রাঘব শুধু বলল,
-“আজ তোকে বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে প্রিয়াঞ্জলী।”
-“বাহবা। আমাকে কি আজ প্রথম দেখলি। হাঁদারাম একটা। চল চল গিয়ে বসি। অনেক কথা বলার আছে।
-“হ্যাঁ চল।” বলেই বললো,
-” ও হ্যাঁ এই নে তোর জন্য এটা।”
-“ওমা কি করে জানলি? এই কবিতার বইটা আমার পছন্দের।”
-“আমাকে হাঁদারাম বলছিলিস না; তুই তো হাঁদারাম একটা।”
-“কেন?”
-“কেন মানে? সারাক্ষন তো লাইব্রেরীতে গিয়ে এই বইটা থেকে কবিতা পড়তিস , আমি দেখেছি। আর এতদিন হয়ে গেলো আমি তোকে চিনি না নাকি? কোনটা তোর পছন্দ কোনটা তোর অপছন্দ, আমি সব জানি।”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা আমার ঘাট হয়েছে।”
-“এবার বল কি বলবি।”
-“হ্যাঁ। রাঘব বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। রেজাল্ট বেরোলেই আমার বিয়ের দিন ঠিক হবে। তুই তো আমার সব থেকে ভালো বন্ধু তাই তোকেই আমি খবরটা প্রথম দিলাম। মা-বাবা তোদের বাড়িতে যাবেন। আর বাবা বলেছে তোকে সবসময় থাকতে হবে।”
-“কি? বিয়ে? কবে ঠিক হলো এসব? আগে তো বলিসনি?চমকে উঠলো রাঘব।”
-“আগে জানলে তো বলবো।”
-“যাক ভালোই তো। তোকে যে দেখবে তারই পছন্দ হয়ে যাবে। তোকে ভালো না বেসে থাকাই যায় না।”
রাঘবের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেলো প্রিয়াঞ্জলীর বিয়ের কথা শুনে। তবুও সমস্ত কষ্ট চেপে হাসিমুখে কথা বলল রাঘব প্রিয়ঞ্জলীর সঙ্গে। প্রিয়াঞ্জলী বলল,
-“কেমন চমকে দিলাম বল।”
-হ্যাঁ দারুন চমকে গেছি। এতো ভালো একটা খবর পাবো আসা করিনি রে।”
-“তুই যেন কি বলবি বলছিলিস?”
-“আমি বলছিলাম ভুলে যাস না যেন আমাকে কোনো দিন।”
-“ভুলে যাবো কেন? ধুর কি যে বলিস না তুই! এই তোর জরুরী কথা।”
-“যাক গে বাদ দে। আমি এবার আসি রে। অনেক দেরি হয়ে গেলো, মা ভাববে। ভালো থাকিস।”
-“আচ্ছা। সাবধানে যাস। আমিও ফিরবো এবার। আবার দেখা হবে।”
এরপরের গল্প আর কিছুই নেই। প্রিয়াঞ্জলী আর রাঘব দুজন দুই প্রান্তে হাঁটতে আরম্ভ করল তাদের জীবনের মতো।
রাঘব এখন ইতিহাসে P .H .D করছে। সেই যে গোলাপগুলো রাঘব প্রিয়ঞ্জলিকে দেবে বলে কিনছিল তা আর দেওয়া হয়নি। বাড়ি ফিরে দেখে ফুলের পাপড়ি গুলো ঝরে গেছে। রাঘব প্রিয়াঞ্জলীর বিয়েতেও যায়নি। সে তার দাদুর বাড়ি বর্ধমানে চলে গিয়েছিলো। প্রিয়াঞ্জলীকে রাঘব কোনোদিন ভুলতে পারেনি। এই স্বপ্নের নগরী প্রিয়াঞ্জলীর স্মৃতিগুলোই রাঘবের কাছে চিরজীবনের জন্য রেখে গেলো জীবনের প্রতিটা পাতায়।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Debanshu Ghosh |
Narrator | Souradip Roy |
Introduction | Debanshu Ghosh |
Characters | Name |
---|---|
Raghab | Debanshu Ghosh |
Priyanjali | Priyanka Dutta |
Others Characters | Soumen Sadhukhan, Olivia Das, Joydeep Lahiri |
https://www.facebook.com/srijoni
good story