দোলে চুরি

Views: 30

দোলে চুরি:

সৃজনরা কলকাতায় থাকে; সৃজন, সৃজনের বাবা এবং মা। সৃজনদের আদি বাড়ি মেদিনীপুরে। একসময় সৃজনের পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন। এখন আর সেই বিশাল জমিদারিও নেই, আর সেই প্রতিপত্তি নেই। কিন্তু তাদের বিশাল বড় জমিদার বাড়িটা রয়ে গেছে। সেখানে সৃজনের কাকু এবং কাকিমা থাকেন।  সৃজনদের দেশের বাড়িতে প্রতি বছরে দোল উৎসবে রাধাকৃষ্ণের পূজো হয়, কিন্তু আগের মতো তেমন আর জৌলুশ নেই। কয়েক বছর হলো সৃজনদের দেশের বাড়ির পাড়াতে দোল উৎসব উপলক্ষে সৃজনদের বাড়ির থেকেও বড়ো করে রাধাকৃষ্ণের পুজো শুরু হয়েছে।

এবারেও তার ব্যাতিক্রম হবে না।  সৃজনের বাবা ক্যালেন্ডার দেখতে দেখতে সৃজনের মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“দোল তো এসে গেছে গো, কালবাদ পরশু ।”

সৃজনের মা : “হ্যাঁ, দেশের বাড়িতে যাওয়ার সময় টা চলেই এলো। তোমায় তো কবে থেকে বলছি, তুমি তো কানই দিছো না।”

সৃজনের বাবা বললেন,

-“চলো কালকেই বেরিয়ে পড়া যাক তাহলে। আর সৃজন তুই এই বছরেও কি তোর কোনো  বন্ধুকে নিয়ে যাবি?”,সৃজনের দিকে তাকিয়ে বললো।

সৃজন বেশ উৎসাহের সাথেই  বলল,

-“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তাহলে আমার দুই বন্ধু অয়ন আর অনুভবকে নিয়ে যাব।   ফোন করে ওদের   যাওয়ার খবরটা জানিয়ে দি ।”

সৃজনের বাবা বললেন,

-” কিগো তুমিও যাও তাহলে, ব্যাগ গুছিয়ে নাও। “

সৃজনের মা বললেন,

-“হ্যাঁ গো হ্যাঁ, রান্নাটা করে গুছিয়ে নিচ্ছি।”

ভিতরের ঘর থেকে দৌড়ে এসে সৃজন বলল

-“মা ওরা কাল স্টেশনে এসে দাঁড়াবে। আমি ওদের সময় জানিয়ে দিয়েছি।”

পরের দিন দুপুরে সৃজন ও তার বাবা মা হাওড়া স্টেশনে সঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হয়ে দেখে ওর বন্ধুরা কেউই এখনো আসেনি।

সৃজন অস্থির হয়ে বলল

-“কোথায় যে গেল ওরা? কখন যে আসবে কে জানে? কাল তো time বলে দিয়েছিলাম। “

 হঠাৎই ওদের দুজনকে আসতে দেখে সৃজন বলল

-“ওইতো ওরা আসছে দুজনে হেলে দুলে।”

অনুভব এসেই সৃজন কে বলল,

“সরি ভাই একটু দেরি হয়ে গেল, তা  টিকিট কেটে নিয়েছিস মেদিনীপুরের?”

 সৃজন বলল,

-“হ্যাঁ রে”

সৃজনের বাবা  জানতে গিয়েছিলেন মেদিনীপুর যাবার ট্রেন কোন প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে? জেনে এসেই সেই দিকেই রওনা দিল সবাইকে নিয়ে। সৃজনের বাবা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-” ছেলেগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চলো তাড়াতাড়ি,আমি জিনিসপত্র নিয়ে একটু এগিয়ে যাচ্ছি তুমি সাবধানে নিয়ে এসো ওদের। “

ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললো সৃজনের বাবা,

“এই তোরা সব সাবধানে আয়, গাড়ি ১৪ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে” বলেই এগিয়ে গেলেন।

সৃজনের বাবা সিট খুঁজতে খুঁজতে বললেন,

-“এই তো এই পাশের পাঁচটা সিট্ আমাদের। “

 হঠাৎ করেই আরেকজন প্যাসেঞ্জার ভদ্রলোক বিরক্তির সঙ্গে বলল,

-“এই জায়গাটা কিন্তু আমার” তার উত্তরে সৃজনের মা বললেন “সে আপনি বসুন না আপনার জায়গায় কি আমরা বসছি?”

কিছুক্ষন পর আর এক  ঘটনা। ট্রেনে যা হয় আর কি! জানলার ধারে বসার ইচ্ছা সবারই থাকে, এই বাচ্ছা গুলোও তাই হলো। অনুভব অয়নকে বলল,

-“এই অয়ন কাকিমাকে বলনা রে, ওই ভদ্রলোক যেন জানালার ধারের সিট্ টা আমাদের দেন ।”

অয়ন বলল,

-“দাঁড়া বলে দেখি। কাকিমা ওই ভদ্রলোককে বলুন না জানলা ধারের  সিটটা আমাদের একটু দিতে। “

কাকিমা অর্থাৎ সৃজনের মা কিছু বলার আগেই ওই ভদ্রলোক কথাটা শুনতে পেয়ে, চেঁচামেঁচি করে এক হুলুস্থূল কান্ড পাকালেন। আর মুখে এক কথা

-“না না আমি জানলা ছাড়বো না, যত সব উটকো ঝামেলা। “

তখন সৃজনের বাবা গেটের কাছ থেকে এসে এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামায় আর বলেন,

-“আচ্ছা দাদা আপনি ওখানেই বসুন, আর তোরা নিজেদের সিটেই  বস, অযথা বায়না করিস না “

প্রায় ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর ট্রেন সময় মতো মেদিনীপুরে প্লাটফর্ম এসে থামল।

সৃজনের বাবা ট্রেন থেকে নেমেই বললেন,

-“আহঃ কতদিন পর এই গ্রামটাকে দেখলাম।”

সৃজনের মা সায় দিয়ে বললেন,

-“ঠিক বলেছো”

অয়ন বলল,

-“আমাদের কলকাতায় তো শুধুই বড় বড় বিল্ডিং আর গাড়ি”

অনুভব অভিভূত হয়ে অয়নের কথার উত্তরে বলল,

-“আর এখানে দেখ কত সবুজ গাছ কত Fresh Air. “

সৃজনের মা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“এবার একটা অটো দেখো নইলে বাড়ি পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে।”

সৃজনের বাবা

-“হ্যাঁ হ্যাঁ”,

বলেই সামনে অটো স্ট্যান্ডএর দিকে এগিয়ে গেলেন ।

সৃজনের বাবা একটা অটোকে ডেকে বললো,

-“এই অটো জমিদার বাড়ি যাবে?”

অটোওয়ালা বললেন,,

-“হ্যাঁ যাবো তবে মাথা পিছু ১৫ টাকা করে লাগবে।” 

সৃজনের বাবা বললেন,

-“বেশ বেশ চলো”

এরপর সবাই অটোতে উঠে বসলো। অটো বাড়ির সামনে আসতেই সৃজনের কাকা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,

-“আরে দাদা তুমি এসে গেছো?”

সৃজনের বাবা:

-” হ্যাঁ? এই চলে এলাম। কালকেই তো দোল”

সৃজনের কাকা:

-“তা ভালো করেছো, সৃজন কই রাজা তো সৃজনএর অপেক্ষায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে।”

রাজা হল সৃজনের কাকার ছেলে। সৃজন এর থেকে তিন বছরের ছোট ক্লাস ৭এ  পড়ে। সবার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে রাজা বাড়ির ভিতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে সৃজন কে দেখে বলল,

-“সৃজনদাদা  তুমি এসে গেছো”

সৃজন : ” হ্যাঁ? আর আমার সাথে আমার আরো দুটো বন্ধু এসেছে অয়ন আর অনুভব। ওরাও কিন্তু তোর দাদা হবে। “

রাজা : “তোমরা সবাই ভেতরে এসো।  মা মা দেখো জেঠুরা এসে গেছে।”

বলেই রাজা দৌড়ে গিয়ে তার মাকে সৃজনদের আসার খবরটা দিয়ে দিল।

রাজার মা বাইরে বেরিয়ে এসে সবাইকে দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন,

-“এসো তোমরা ভেতরে এসো।”

সৃজনের কাকা বললেন,

-“আজ বেশ রাত হয়ে গেছে। তোমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করি তোমরা খেয়ে বিশ্রাম নাও।  কাল না হয় বাকি কথা হবে।“

সৃজনের মা সৃজনকে বললেন,

– “তুই তোর বন্ধুদের নিয়ে একটা ঘরে শুয়ে পড়, আমরা পাশের ঘরে আছি।“ 

 রাজা বলল,

” হ্যাঁ শুয়ে পড়ো, খুব সকালে উঠতে হবে, কাল দোল, খুব মজা হবে”

এই বলে সবাই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে রাজা সেই জন্য ঘরে এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকে। 

-“সৃজন দাদা ওঠো দোল খেলার সময় হয়ে এলো যে”

সৃজনের মা নিচের তলা থেকে হাঁক দিয়ে বললেন,

-“এই তোরা সবাই রেডি হয়ে খেতে আয়।”

সৃজন ঘুম থেকে ধড়মড় করে উঠে বসে, ও  বাকি দুই বন্ধুদেরও ডেকে তোলে।

-“এই তোরা তাড়াতাড়ি উঠে পড় মা ডাকছে এরপর সবাই রেডি হয়ে জল খাবার খেয়ে দোল খেলতে যাব।“

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে  রাজা রং নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খেয়ে দেয়ে রাজা রং গুলতে গুলতে বললো,

-“কেমন লাগছে দাদা তোমাদের আমাদের এখানে?”

অয়ন বললো,

-“দারুন লাগছে, বল অনূভব।”

অনূভব: “সে আর বলতে। আমাদের কপালটাই খারাপ, সৃজন প্রতি বছর এখানে এসে কত আনন্দ করে, আর আমরা ওখানে বসে থাকি। “

অয়ন: “ঠিক বলেছিস।”

এমন সময় পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। গাড়ি এসে গেটের বাইরে থামলো। পুলিশের গাড়ি থেকে ইন্সপেক্টর নেমে এসে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

-“আমি লোকাল থানার অফিসার ইনচার্জ অভিরূপ সান্যাল। প্রতিবছর পাড়ায় যে মন্দিরের দোল উৎসবে রাধা কৃষ্ণের পূজো হয় এবং পুজোর জন্য যে সোনার গয়না আনা হয় সেই গয়না এবার চুরি হয়ে গেছে আর আমার কাছে খবর আছে এই বাড়িরই একজন সেই গয়না চুরি করেছে।”

 সবাই একসাথে বলে উঠলো,

-” কে? কে?  কে চুরি করেছে?”

 ইন্সপেক্টর সৃজনের কাকিমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“উনি! উনি ঠাকুরের গয়না চুরি করেছেন।”

সৃজনের কাকা বললেন,

“কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

ইন্সপেক্টর বললেন,

-“মন্দিরের সিসি টিভি ফুটেজ। কি ভালোয় ভালোয় সত্যি কথা বলবেন নাকি..”

হঠাৎই কাকিমা বলে ওঠে,

-“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি করেছি চুরি। প্রতিবছর পাড়ার মন্দিরে আমাদের বাড়ির মন্দিরের গয়নার থেকে ভালো গয়না দেওয়া  হয়। আমাদের এখন জমিদারি জৌলুষ নেই, বিশাল অবস্থাও নেই। কিন্তু তাও একটা সম্মান আছে। পাড়ার সবাই ইচ্ছা করে আমাদের পরিবারকে নিচু দেখাবে বলে প্রতিবছর আমাদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করে। আমার এই ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগতোনা, তাই আমি এবার এই চুরি  করতে বাধ্য হয়েছি । “

ইন্সপেক্টর বললেন,

-“সবইতো বুঝলাম কিন্তু আপনি মন্দিরের গয়না ফেরত দিয়ে দিন। আমি আপনার শাস্তি কমানোর চেষ্টা করব।“  সৃজনের কাকিমা তৎক্ষণাৎ দুজন মহিলা কনস্টেবলের সঙ্গে ভেতর থেকে গয়না নিয়ে এলেন এবং বললেন,

-“এই নিন গয়না।”

গয়না পর্যবেক্ষণ করে ইন্সপেক্টর বললেন,

-“আপনি নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়ে সমস্ত গয়না ফেরত দিয়েছেন বলে এবং আপনাদের একটা সম্মান আছে বলে আমি আপনাকে থানায় নিয়ে গেলাম না। কিন্তু এই ভুল দ্বিতীয়বার করলে আর ছাড়  পাবেন না। “

তারপরেই সৃজনের কাকিমা কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে পরেন। এইসব দেখে সৃজনের কাকা বললেন,

-“আমি পরের বছর থেকে ভালো গয়না গরানোর চেষ্টা করব”।

সৃজনের বাবা বললেন,

-“আমিও তোকে  সাহায্য করবো। আবার দুজনে মিলে  পুজোর পুরোনো জৌলুষ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবো।”

অনুভব বলল,

“যাই হোক শেষ ভালো যার সব ভালো তার।”

Audio Story Starts From Here:

Story InfoName
WriterSoham Sadhukhan
Intro & EndingPriyanka Dutta
কথকSouradip Roy
CharactersName
SrijonJoydeep Lahiri
Srijon’s FatherDebanshu Ghosh
Srijon’s MotherOlivia Das
Srijon’s UncleDebanshu Ghosh
Srijon’s AuntyPriyanka Dutta
AnubhavSoumen Sadhukhan
AyanJoydeep Lahiri
Police OfficerSouradip Roy

Find us on Facebook – click here

আরো পড়ুন

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *