কোন্নগরের কালো রাত

Views: 2

কোন্নগরের কালো রাত:

আমি রাজীব চক্রবর্তী। পেশায় একজন সাংবাদিক। কলকাতার একটি বড় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় কাজ করি। গত পাঁচ বছর ধরে আমি ভূতের গল্প নিয়ে গবেষণা করে আসছি। কিন্তু আজ যে গল্পটা লিখতে বসেছি, সেটা আমার নিজের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। 

গত বছরের ৩১শে ডিসেম্বর। ইংরেজি নববর্ষের আগের দিন। আমার এক বন্ধু ফোন করে জানাল যে হুগলি জেলার কোন্নগরে নাকি একটা পুরনো বাড়িতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় লোকজন রাতে সেখান থেকে আলোর ঝলকানি আর চিৎকারের শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু যখন কেউ দেখতে যায়, তখন কিছুই পাওয়া যায় না।

একজন সাংবাদিক হিসেবে এবং ভূতের গল্পের গবেষক হিসেবে আমার মনে স্বাভাবিক কৌতূহল জাগল। ঠিক করলাম নববর্ষের রাতটা ওই বাড়িতে কাটিয়ে আসব। বন্ধুর কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ কোন্নগর রওনা দিলাম।

কোন্নগর স্টেশনে নেমে রিকশা নিলাম। রিকশাওয়ালা  লোকটি জানতে চাইলেন কোথায় যাব। যখন বললাম রায়চৌধুরী বাড়ি, তখন তিনি চমকে উঠলেন। বললেন, “বাবু, ওই বাড়িতে কেউ যায় না। ওটা ভূতের বাড়ি।”

আমি হেসে বললাম, “কাকু, আমি সাংবাদিক। ভূতের গল্প নিয়ে লিখি। ভয় পাই না।”

রিকশাওয়ালা  মাথা নেড়ে বললেন, “দেখুন বাবু, আমি পঞ্চাশ বছর ধরে এই কোন্নগরে রিকশা চালাই। অনেক কিছু দেখেছি। রায়চৌধুরী বাড়ির ইতিহাস জানি। স্বাধীনতার আগে থেকে ওই বাড়ি আছে। রায়চৌধুরী পরিবার ছিল জমিদার। তাদের একমাত্র মেয়ে মালতী। খুব সুন্দরী ছিল। কিন্তু নববর্ষের রাতে কী যে হল, কেউ জানে না। সকালে দেখা গেল অপর্ণা নেই। তারপর থেকে প্রতি বছর নববর্ষের রাতে…”

রিকশাওয়ালা থামলেন। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”

“তারপর থেকে প্রতি বছর নববর্ষের রাতে ওই বাড়ি থেকে মেয়েলি কান্নার শব্দ শোনা যায়। কেউ কেউ বলে, একটি শাড়ি পরা মেয়েকে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।”

গল্প শুনে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। রিকশা এগিয়ে চলল। গঙ্গার ধার ঘেঁষে পুরনো রাস্তা। দুপাশে প্রাচীন বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে নীরব সাক্ষীর মতো। সন্ধ্যা নামছে। আকাশে মেঘ জমেছে।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর রিকশা একটা বিশাল লোহার গেটের সামনে থামল। গেটের ওপরে লেখা ‘রায়চৌধুরী নিবাস’। দু’পাশে দুটো সিংহের মূর্তি। গেটের তালা ভাঙা। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিশাল বাগান। অযত্নে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। মাঝখানে পাথরের রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ভাঙা মূর্তি।

বাড়িটা দোতলা। লাল রঙের। কালো কালো জানালা। সামনের বারান্দায় চারটে থাম। থামের গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে আছে। দরজা-জানালায় কাঠের কারুকাজ। কিন্তু সবই জীর্ণ, ভাঙা।

সূর্য ডুবে গেছে। চারদিকে অন্ধকার নামছে। রিকশাওয়ালা আর দাঁড়াল না। বলল, “বাবু, আমি চললাম। আপনি সাবধানে থাকবেন।”

আমি ব্যাগ থেকে টর্চ বের করলাম। সঙ্গে ক্যামেরা, নোটবুক, পেন, জলের বোতল আর কিছু বিস্কুট আছে। ভেতরে ঢোকার আগে বাড়ির ছবি তুললাম কয়েকটা।

প্রধান দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকতেই নাকে ধুলো আর পচা কাঠের গন্ধ। বিশাল হলঘর। দেয়ালে টাঙানো পুরনো ছবি। একটা ছবিতে দেখলাম এক তরুণী। সাদা শাড়ি পরা। চোখে করুণ দৃষ্টি। নীচে লেখা , ‘অপর্ণা রায়চৌধুরী, ১৯৪৭’।

হলঘরের একপাশে সিঁড়ি। ওপরে উঠে দেখি, লম্বা করিডর। দুপাশে ঘর। প্রথম ঘরটা খুলতেই দেখি, পুরনো আসবাবপত্র। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল। ধুলোয় ঢাকা। দ্বিতীয় ঘরে একটা পিয়ানো। তৃতীয় ঘরটা বোধহয় অপর্ণার ঘর ছিল। দেয়ালে তার ছবি। টেবিলে একটা ডায়েরি।

ডায়েরিটা খুলে দেখি, শেষ এন্ট্রি ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৪৭। লেখা আছে: “আজ শেষ দিন। কাল নতুন বছর। কিন্তু আমার জীবনে আর কোনো নতুন সূর্যোদয় নেই। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন রায়বাহাদুর মিত্তিরের ছেলের সঙ্গে। কিন্তু আমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসি। কী করব? কোথায় যাব?”

রাত বাড়ছে। বাইরে বাতাস বইছে। জানালার পর্দা উড়ছে। হঠাৎ নীচে থেকে পিয়ানোর শব্দ। আমি চমকে উঠলাম। কে বাজাচ্ছে? নীচে নেমে দেখি, পিয়ানোর ঘরে কেউ নেই। কিন্তু পিয়ানোর চাবিগুলো নড়ছে। একটা করুণ সুর বেজে চলেছে।

ঘড়িতে রাত এগারোটা। আমি হলঘরে বসে আছি। টর্চের আলো জ্বালিয়ে রেখেছি। হঠাৎ ওপর থেকে পায়ের শব্দ। কে যেন হাঁটছে। আমি উপরে উঠলাম। করিডরে কেউ নেই। কিন্তু  অপর্ণার ঘরের দরজা খোলা।

ঘরে ঢুকতেই দেখি, জানালার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে। সাদা শাড়ি পরা। আমি টর্চ ফেললাম। কিন্তু সেখানে কেউ নেই।

রাত বারোটা বাজল। নতুন বছর শুরু হল। হঠাৎ চারদিকের আলো নিভে গেল। টর্চও কাজ করছে না। অন্ধকারে শুনতে পেলাম কান্নার শব্দ। মেয়েলি কণ্ঠ। “আমাকে বাঁচাও… আমাকে বাঁচাও…”

আমি ছুটে বাইরে আসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে দেখলাম, বাগানে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে। সাদা শাড়ি পরা। লম্বা চুল। সে হাত নাড়ছে, যেন ডাকছে।

আমার সারা শরীরে ঘাম। কিন্তু একজন সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে সামলে নিলাম। ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ক্যামেরাও কাজ করছে না।

হঠাৎ পিছন থেকে শীতল স্পর্শ। ঘুরে দেখি সেই মেয়ে। অপর্ণা। ফ্যাকাশে মুখ। করুণ চোখ। সে বলল, “শোনো… আমার কথা শোনো…”

আমি থরথর করে কাঁপছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করলাম, “কী… কী বলবে?”

অপর্ণা বলল, “আমি পালিয়ে যাচ্ছিলাম। অভিজিতের সঙ্গে। কিন্তু বাবা জেনে গেলেন। তিনি… তিনি অভিজিতকে…” তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।

“কী করলেন তোমার বাবা?”

“তিনি অভিজিতকে খুন করলেন। তারপর আমাকে এই ঘরে বন্দী করে রাখলেন। আমি আত্মহত্যা করলাম। কিন্তু আমার আত্মা শান্তি পায়নি। প্রতি বছর এই রাতে আমি ফিরে আসি। অভিজিতকে আজও খুঁজে বেড়াই।”

আমি বললাম, “কিন্তু এখন কী চাও তুমি?”

“অভিজিতের দেহ বাগানে পোঁতা আছে। সেই জায়গাটা খুঁড়ে দেখো। তাকে সৎকার করো। তাহলে আমরা শান্তি পাব।”

ভোর হল। আমি পুলিশে খবর দিলাম।

এক বৃদ্ধ বললেন, “আমি তখন ছোট ছিলাম। কিন্তু সব মনে আছে। অপর্ণাদি খুব ভালো পিয়ানো বাজাতেন। রোজ সন্ধ্যায় তাঁর সুর ভেসে আসত। অভিজিৎ মাস্টার পড়াতে আসতেন। দুজনের মধ্যে ভালোবাসা জন্মায়। কিন্তু জমিদার বাবু রাজি হননি।”

আরেকজন বললেন, “সেই রাতে আমরা গুলির শব্দ শুনেছিলাম। পরের দিন খবর পেলাম, অপর্ণাদি আর অভিজিৎ মাস্টার দুজনেই মারা গেছেন। জমিদার বাবু পাগল হয়ে গেলেন।”

আমি জানতে চাইলাম, “এখন বাড়িটার মালিক কে?”

“সরকার। কেউ কিনতে চায় না। সবাই জানে, রাতে এখানে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।”

আমি ফিরে এলাম কলকাতায়। রিপোর্ট লিখলাম। এডিটর প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। কিন্তু যখন পুরনো খবরের কাগজে ঘটনার সত্যতা পেলেন, তখন ছাপতে রাজি হলেন।

একমাস পর আবার গেলাম কোন্নগর। সেই বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হঠাৎ দোতলার জানালায় দেখলাম দুটি মূর্তি। অপর্ণা আর অভিজিত। দুজনেই হাসছে। পিয়ানোর সুর ভেসে আসছে।

এখন প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি আমি যাই সেই বাড়িতে। বসে থাকি হলঘরে। শুনি পিয়ানোর সুর। দেখি দুটি প্রেমিক- প্রেমিকাকে , মৃত্যুও যাদের ভালোবাসাকে আলাদা করতে পারেনি।

স্থানীয়রা এখন আর ভয় পায় না। বরং গর্ব করে বলে, তাদের এলাকায় এমন একটি প্রেমের কাহিনী আছে। প্রতি বছর নতুন বছরের প্রথম দিনে অনেকে আসে। দূর থেকে দেখে যায় সেই বাড়ি। শোনে পিয়ানোর সুর।

আমি এখন বুঝতে পেরেছি, ভূত বা প্রেতাত্মা আসলে আমাদের মতোই। তাদেরও আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে। হয়তো তাই তারা চলে যায় না। থেকে যায় সেই জায়গায়, যেখানে তাদের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি।

রায়চৌধুরী বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কোন্নগরের বুকে। কালের সাক্ষী হয়ে। প্রেমের সাক্ষী হয়ে। আর প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে বাজে পিয়ানোর সুর। দুটি আত্মা আজও এক হয় ভালোবাসার বন্ধনে।

আমার রিপোর্ট পড়ে অনেকে এখন আসে। কেউ ভয় পায়, কেউ মুগ্ধ হয়। কিন্তু সবাই জানে, এটা শুধু একটা ভৌতিক গল্প নয়। এটা ভালোবাসার গল্প। যে ভালোবাসা মৃত্যুকেও জয় করেছে।

আজও যখন রাতে সেই এলাকা দিয়ে যাই, শুনতে পাই পিয়ানোর সুর। মনে হয়, অপর্ণা বাজাচ্ছে, আর অভিজিত শুনছে। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছে নিজেদের এক অনন্ত সংসার। যেখানে শুধু ভালোবাসা আছে, ঘৃণা নেই। যেখানে জাত-পাত, ধনী-গরিব, জীবন-মৃত্যু কোনো বাধাই নেই।

এই গল্প লেখার পর থেকে অনেক পাঠক আমাকে চিঠি লিখেছেন। কেউ জানতে চেয়েছেন, এটা সত্যি কিনা। আমি বলি, যা দেখেছি, যা শুনেছি, তাই লিখেছি। বিশ্বাস করা না করা পাঠকের ওপর নির্ভর করে।

তবে একটা কথা বলতে পারি। প্রেম যদি সত্যি হয়, তবে তা মৃত্যুকেও অতিক্রম করে। হয়তো তাই অপর্ণা আর অরূপ আজও আছে সেই বাড়িতে। হয়তো তাই প্রতি নতুন বছরের প্রথম দিনে তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয় সেই পুরনো রায়চৌধুরী বাড়ি।

Audio Story Starts From Here:

Story InfoName
WriterOlivia Das
Intro & EndingDebanshu Ghosh
Kothak Debanshu Ghosh
CharactersName
RajibDebanshu Ghosh
AparnaPriyanka Dutta
Riskawala Sumit Bari

Find us on Facebook – click here

আরো পড়ুন

What’s your Reaction?
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0
+1
0

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *