চিলেকোঠা

Views: 12
চিলেকোঠা:
আমার নাম বরুণ গুপ্ত। একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। এক বছর হল এম.এস.সি পাশ করেছি। অনেক দিন ধরেই চাকরির চেষ্টা করছিলাম। যেগুলো পেয়েছিলাম সেগুলো খুব একটা পছন্দ হয় নি। আমার পছন্দ বরাবরই একটু অন্য ধরণের। সেদিন সকালে খবরের কাগজটা পড়ার সময় হঠাৎ একটা অন্য রকম কাজের বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। মংপু অঞ্চলের একটা বাড়িতে গৃহ শিক্ষক প্রয়োজন। যার জন্যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে সে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছেলেটির মা বাবা ছেলে কে বাড়িতেই লেখাপড়া করাতে চান, তাই তারা এরকম একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আমি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম এই কাজ টাই করব।
পাহাড় ঘোরার শখ টা আমার ছোট্ট থেকেই তাই বাবার ছুটি থাকলেই চলে যেতাম পাহাড়ের কোলে মন ভালো করতে। বিজ্ঞাপনটা ভালো করে খুঁটিয়ে পড়ে দেখে নিলাম কি কি যোগ্যতা চাইছেন ওনারা। সবকটাই আমার সাথে মিলে যাওয়াতে চিঠি লিখে বিজ্ঞাপনটার উত্তর দিয়ে দিলাম। দিন দশেক পর উত্তর এলো যে তারা আমাকে তাদের সন্তানের গৃহ শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেছেন এবং বাকি কথা ওখানে গিয়ে হবে বলে জানিয়েছেন। আমি সেই দিন ট্রেনের একটি তৎকাল টিকিট কেটে পরের দিনই রওনা দিলাম। কারণ এত তাড়াতাড়ি ট্রেন এর টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু ওনারা চাইছিলেন আমি যেনো তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছে যাই।
ট্রেন খুব সকালে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছলো। স্টেশন থেকে বেরোতে একজন লোককে দেখলাম একটা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়িটার নম্বর আমি জানতাম কারন সেটা চিঠিতে লেখা ছিল। লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-” আপনি বরুণ বাবু আছেন?”
আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম,
-” হ্যাঁ”।
তখন সে বললো,
-“মালিক আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে নিয়ে যেতে। আসেন আমার সাথে। আমি উনার ড্রাইভার আছি।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা পাহাড় আর তার বুক চিরে চলে যাওয়া রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মনটা খুব আনন্দে ভরে উঠলো। প্রায় দুঘন্টা পর আমরা সেই বিজ্ঞাপন দাতা ব্যক্তির বাড়িতে পৌঁছলাম। তিনি আমায় অত্যন্ত আন্তরিকভাবে স্বাগত জানালেন এবং বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। ওনার স্ত্রী পাশের ঘর থেকে আমার সাথে দেখা করতে এলেন। ওনাদের দুজনকে দেখে মনে হল দুজনেই সারাদিন নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকেন। কারন ভদ্রমহিলা তার কাজের লোকটিকে বারবার বলছিলেন,
-” সব কিছু দেখে রেখো আর সমুদ্র কে ঠিক সময়ে খাইয়ে দিও আর দাদাবাবুর টিফিন টা সময় মত দিয়ে আসবে।”
আমি বসার ঘরে আসার আগে এইটুকু শুনতে পেয়েছিলাম।ওনারা আমার সামনের সোফা টায় বসলেন। আমার জন্য চা ও জল খাবার আনার ব্যবস্থা করা হল। ভদ্রলোক বললেন,
-” খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনটা তে আশা করি সব কিছুই পড়ে নিয়েছেন। আমি অখিলেশ সান্যাল। এখানকার একটা টি এস্টেট এর ম্যানেজার আর উনি আমার স্ত্রী নন্দিনী সান্যাল। উনি একজন স্কুল শিক্ষিকা। আমাদের একটা মাত্রই সন্তান। ওর নাম সমুদ্র। আপনি তো সবই জানেন কেনো আমরা একটা গৃহ শিক্ষক চাইছিলাম। এখানে অনেকেই এই কাজের জন্য এসেছিল কিন্তু কেউই তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন নি। তাই ভাবলাম কলকাতার দিকে আরও অনেক বেশি শিক্ষিত মানুষ থাকেন যারা হয় তো আমার ছেলেকে আরো ভালোভাবে শেখাতে পারবেন।আপনি এখানে থাকা খাওয়া সব পাবেন এবং মাস গেলে মোটা টাকা মাইনে পাবেন। আমরা শুধু চাই আপনি ওর শিক্ষকের পাশাপাশি ওর বন্ধু হয়ে উঠুন যাতে ও পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিকভাবে অনেকটাই সুস্থ হতে পারে।”
সব শুনে আমি বললাম,
-” দেখুন সব বুঝলাম। আমিও চেষ্টা করব আর আমি আশা করব আপনারাও আমাকে সাহায্য করবেন এই ব্যাপারে। তবে সবার আগে ছাত্রটি কে দেখতে হবে এবং তার মনের অবস্থা বুঝতে হবে। আশা করি ওর মনের মত শিক্ষক হয়ে উঠতে পারব।”
ওনারা আমার কথা শুনে কিছুটা শান্তি পেলেন এবং আমাকে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন। সেইদিন শরীরটা ক্লান্ত থাকায় আর ঘর থেকে বের হইনি। দুপুরের খাবার টা ঘরে খেয়েছিলাম। বিকেলে আমার সাথে সমুদ্রের দেখা হল। সে বাগানটার একটা কোনায় বসেছিল হাতে বল নিয়ে। আমাকে দেখে কিঞ্চিৎ ভয় পেলো মনে হয় তাই মালি কে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। আমি তখন ওর কাছে গিয়ে ওকে বলি,
-” হ্যালো! আমি তোমার নতুন টিচার। আমার নাম বরুণ গুপ্ত। তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে? আমি তোমাকে বকব না। তোমাকে অনেক কিছু শেখাবো।”
সমুদ্র কিছুক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,
-” তুমি সত্যি বলছ যে তুমি আমাকে বকবে না?তাহলে আমরা বন্ধু হতে পারি। আমার নাম সমুদ্র সান্যাল। I am 8 years old।”
আমি হেসে বললাম,
-” ঠিক আছে। এখন তাহলে চলো তো তোমার ঘরে গিয়ে তোমার বই গুলো একবার দেখাবে আমায়।”
আমি সমুদ্রের হুইল চেয়ারটা আস্তে আস্তে ধরে ওকে ঘরে নিয়ে গেলাম। দুই দিনের মধ্যে ওর সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ওকে আমি মন দিয়ে সব কিছু শেখাতে শুরু করলাম। আমারও দিন বেশ ভালোই কাটছিল। সারাদিন সমুদ্রের সাথেই আমার সময় কেটে যেতো। সমস্যাটা দেখা দিলো একদিন রাতে। সকাল থেকেই ওর শরীরটা ভালো ছিল না। অনেক বার জ্বর এসেছে আবার ছেড়েও গেছে। আমি সবসময়ই ওর মাথার সামনে বসেছিলাম। রাতে খাওয়ার পর আমি ওর ঘরে এসে আবার বসলাম। ছেলে টার জন্য খুব মন খারাপ লাগছিল। কি প্রাণবন্ত থাকে সবসময়।অখিলেশ বাবু সেদিন একটা কাজে কলকাতা গেছিলেন আর রাতে ফেরেন নি। নন্দিনী দেবী কে জিজ্ঞাসা করায় উনি জানান আগামীকাল চলে আসবেন। এইরকম মাঝে মাঝে ওনাকে নাকি যেতেই হয়। আমার সাথে নন্দিনী দেবী খাওয়া দাওয়া সেরে সমুদ্রের ঘরে এসে সোফায় বসে রইলেন। আমি ওনাকে বললাম,
-” আপনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। আমি জেগে আছি। কোনো অসুবিধা হলে আমি আপনাকে ডেকে নেবো।”
উনি আমার কথায় হেসে বললেন,
-” আমার কোনো অসুবিধা নেই। আর নিজের ছেলের জন্য রাত জাগব এতে অসুবিধা কি? আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
তারপর আমি আর কিছু না বলে একটা চেয়ারে একটু গা এলিয়ে দিলাম। চোখটা লেগে গেছিল একটু।রাত কটা বাজে বুঝতে পারলাম না ঘুমের ঘোরে কিন্তু হঠাৎ করে কারোর একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে পড়লাম। দেখি নন্দিনী দেবী সোফাতে নেই। খাটে সমুদ্র তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি ভাবলাম উনি হয় তো বাথরুমে গেছেন। কিন্তু কান্নার শব্দ টা? কে কাঁদছে এত রাতে? গত এক সপ্তাহ ধরে এখানে আছি এইরকম তো কোনোদিন শুনি নি। আমি ভেজানো দরজা টা খুলে বেরিয়ে এলাম বাইরে এবং অনেকবার নন্দিনী দেবীর নাম ধরে ডাকলাম। কিন্তু কেউ তো কোথাও নেই। বাথরুম এর আলো টাও নেভানো। হচ্ছেটা কি এটা? কান্নার শব্দ টা যেনো আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। কে কাঁদছে এভাবে পাগলের মত? আমি একবার জোরে চিৎকার করে উঠলাম,
-” কে ওখানে? কে কাঁদছে?”
তারপর হঠাৎ করেই কান্নার শব্দ টা থেমে গেলো। আমি বারান্দায় এসে চারদিকটা ভালো করে দেখতে লাগলাম কিন্তু নন্দিনী দেবী কে খুঁজে পেলাম না। ঠিক তখন বাড়ির চাকর রঘু এসে আমাকে বললো,
-” দাদাবাবু, এত রাতে বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। যান খোকাবাবুর ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। রাতের বেলা এভাবে ঘোরাঘুরি করা ঠিক নয়।”
আমি রঘুকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-” ওই রকম ভাবে কে কাঁদছিল? আর সমুদ্রের মা কোথায় গেলেন? তাকে কেনো দেখতে পাচ্ছি না?”
রঘু আমতা আমতা করে বললো,
-” বৌদিমণি নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওইসব কান্না কিছু নয়। পাহাড়ি এলাকা নিস্তব্ধ তো তাই নানারকম আওয়াজ শোনা যায়। আপনি যান দাদাবাবু ঘুমিয়ে পড়েন।”
রঘুর উত্তরে আমার মনের সন্দেহ দূর হল না। বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা লুকানো হচ্ছে আমার থেকে। এই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি আমাকেই করতে হবে। পরের দিন ও সমুদ্রের শারীরিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই। একই রকম দুর্বল আর প্রায় অজ্ঞান হয়েই আছে বলতে হয়। আমি চা খেতে খেতে নন্দিনী দেবী কে প্রশ্ন করলাম,
-” কি ব্যাপার বলুন তো? কাল আপনি কোথায় চলে গেছিলেন? কতবার করে আপনাকে ডাকলাম আপনি কোনো সাড়া দিলেন না আমায়। আপনার শরীর ঠিক আছে?”
উনি বললেন,
-” হ্যাঁ ঠিক আছি আমি। কাল মাথাটা খুব ধরেছিল তাই নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।”
কিন্ত ওনার মুখের ভাব আমাকে নিশ্চিত করেছিলো যে উনি কাল সারা রাত জেগেছিলেন। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে সমুদ্রের কথা তুলি। জিজ্ঞাসা করি,
-” আচ্ছা সমুদ্রের তো কোনো শারীরিক পরিবর্তন দেখছি না। আপনি আপনাদের ডাক্তারের সাথে একবার কথা বলুন। আর অখিলেশ বাবু কখন ফিরবেন?”
নন্দিনী দেবী একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন,
-” উনি দুই দিন পর ফিরবেন। সকালে জানিয়েছে। আমি একটু আসছি। শরীর টা ভালো লাগছে না ঠিক।”
আমি আর কথা বাড়াইনি। সমুদ্রের ব্যাপারে কোনও কথা বললো না দেখে আমিও আর আগ্রহ দেখালাম না। যাদের ছেলে তাদের যখন মাথা ব্যাথা নেই আমি আর কি করব ? এসে থেকে সেভাবে কিছু ঘুরে দেখা হয়নি। তাই গায়ে একটা শাল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বসে বসে কিছু করার ছিল না। যার জন্য এখানে চাকরি নিয়ে আসা সেই এখন শয্যাশায়ী। তাই এখন মাস্টারি বন্ধ। মন ভালো করার জন্য যখন হাঁটতে বেরিয়েছি ঠিক তখনই দেখা হল একজনের সাথে। সেই ভদ্রলোক আমার দিকে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললেন,
-” নমস্কার আমার নাম সুজয় মিত্র। আপনি কি অখিলেশ বাবুর ছেলের শিক্ষক নাকি?”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
-” ওই আর কি। কিন্তু ছাত্র তো বিছানায়। পড়ানো বন্ধ। তাই একটু আশপাশটা ঘুরতে বেরোলাম।”
উনি যেনো একটু বাঁকা হাসি হেসে বললেন,
-” বেশ তো ভালো ছিলেন ভায়া কলকাতায়। কি করতে এলেন এই লোকের বাড়িতে?”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
-” কেন বলুন তো? কোনো সমস্যা আছে নাকি এই বাড়িতে?”
লোকটা হেসে বললো,
” তা আছে বৈকি। কত তো মাস্টারকে আসতে দেখলাম। ছেলেকে আর পড়াতে পারলো কই? তাদের তো আর হদিশ পাওয়া গেলো না। একজন তো রীতিমতো আত্মহত্যা করতেও গিয়েছিলো। অনেক কষ্টে তাকে বাঁচানো গেছে।”
শেষ কথাটা শুনে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে যেনো ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। আমি বললাম,
” আপনি এসব কি বলছেন? কই এসব তো কিছুই শুনি নি আমি।”
উনি বললেন,
” আছেন তো এখন। ধীরে ধীরে সব জানতে পারবেন। আচ্ছা আমি এখন চলি।”
মনটা ভার হয়ে এলো। শেষে কিনা চাকরি করতে এসে প্রাণ খোওয়াতে হবে। বাড়ি ফিরে এসে মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। তাহলে কি কালকের কান্নার সাথে এটার কোনো যোগাযোগ আছে? কোনোরকমে টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে একটু জল খেয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারছিলাম না কি করব। ঠিক তখনই নন্দিনী দেবী আমার ঘরে এলেন। উনি আমাকে বললেন,
-“আপনার জল খাবার দেওয়া হয়েছে। খাবেন আসুন।”
আমি তখনও যেনো ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মুখ দিয়ে কথাটা নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেলো,
-” আপনি কি কাল রাতের কান্নার শব্দ নিয়ে কিছু বলতে পারেন? ঘটনাটা আমার কাছে খুবই রহস্যময় তাই আপনাকেই জিজ্ঞাসা করছি।”
উনি আমার কথা শুনে চমকে উঠে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
-” আপনাকে তো বললাম কাল আমার খুব মাথা ধরেছিল তাই নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওইসব শব্দ কিছু শুনিনি আমি। আপনি খেতে আসুন। আমি এখন আসি।”
উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও আমার মন থেকে চিন্তা দূর হল না। সারাদিন দুশ্চিন্তায় কাটলো। সন্ধের দিকে সমুদ্রের জ্ঞান আসে এবং ও আগের থেকে অনেক টাই সুস্থ বোধ করছিলো। আমি ওকে খাইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এলাম একবার। জানলার দিকে তাকাতেই পা দুটো থমকে গেলো। কারা যেনো ফিসফিস করে কিছু বলছে। তারপর যেনো হঠাৎ তারা কোথায় মিলিয়ে গেলো। আমার ঘরের পেছনে ছিল একটা বড় চাঁপা ফুলের গাছ। আর তার পাশে সেই এক ফালি বাগান। আমি দৌড়ে সেই বাগানে গেলাম। সেই লোক গুলোকে খুঁজতে লাগলাম কিন্তু কেউ কোথাও নেই। আমি বাগানে রাখা চেয়ার দুটোর একটা তে বসে পড়লাম ক্লান্ত হয়ে।
অমাবস্যা ছিল সেদিন তাই চারদিক টা ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু মাত্র ঘর গুলোর জানলা দিয়ে আলো আসছিল অল্প অল্প। সেই সময় হঠাৎ আমার চোখ গেলো তেতলায় ওই ঘরটায়। আমি খুব একটা ছাদে উঠি না কোনোদিনই। আর যদিও উঠি ঘরটা দেখি বন্ধই পড়ে থাকে। আমি চিলেকোঠা ভেবে আর কোনো আগ্রহ দেখাই নি। কিন্তু হঠাৎ করে আজ আলো কেনো জ্বলছে ওই ঘরটায়? তাহলে কি কোনো গোপন কিছু লুকিয়ে আছে ওই ঘরে? আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাগান থেকে সোজা বাড়ির ভিতরে এসে উঠতে লাগলাম সিঁড়ি দিয়ে। আমার মনে তখন নানা প্রশ্ন উঠছে। নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টা করছি। রহস্য উদ্ঘাটন করতেই হবে আমায়। যখন একদম ঘরটার সামনে পৌঁছলাম তখন ভিতর থেকে কোনও মানুষের নিচু গলায় কথা শোনা যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম সে আকুল ভাবে কিছু চাইছে। মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ আসছে। কন্ঠটা যে কার বুঝতে বাকি থাকলো না। উত্তেজনার বশে আমি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ঘরের চারিদিকে মানুষের মাথার খুলি, হাড় ও নানা রকম তন্ত্র সাধনার জিনিস। আর যিনি ঠাকুরের মত একটা দেবী মূর্তির সামনে পড়ে আছেন মুখ গুঁজে তিনি আমার সন্দেহের সেই ব্যক্তি নন্দিনী দেবী। পরণে একটা লাল শাড়ী, গলা তে রুদ্রাক্ষের মালা। এ যেনো কোনো সাধিকা। ঘর টায় কিরকম একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে। চারদিকে এত অন্ধকার যে ভালো করে বুঝতেই পারছিলাম না কোনো কিছু। শুধু কত গুলো মোমবাতি জ্বলছে।
আন্দাজ করতে পারছিলাম ঘর টা বেশ বড়। হঠাৎ পা টা কিছু তে একটা আটকে গেলো। আমি পড়ে গেলাম হোঁচট খেয়ে। মুখটা তুলতেই দেখি সামনে হাঁড়িকাঠ। ঘরটায় জ্বলতে থাকা মোমবাতি গুলোর আলোয় দেখতে পেলাম সেই হাঁড়িকাঠের গায়ে রক্তের দাগ গুলো শুকিয়ে গেছে। বুকটা আমার কেঁপে উঠলো। আমি তখন দেখলাম নন্দিনী দেবী আমার দিকে তাকিয়ে একটা শয়তান এর হাসি হাসলেন। তারপর তার আরাধ্য দেবীর পায়ের কাছে থাকা খাঁড়া টাকে ভালো করে সিঁদুর মাখাতে লাগলেন। ইতিমধ্যে আমার অজান্তে দুটো লোক ঘরে এসে ঢুকেছে। তাদের আমি ভালো করে চিনতে পারি নি। তারা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে সেই হাঁড়িকাঠের মধ্যে আমার মাথা টা ঢুকিয়ে দিলো। আমি পাগলের মত চেঁচাতে লাগলাম,
-” কি করছেন কি? ছেড়ে দিন আমাকে। আপনারা অন্যায় করছেন। আমার কথাটা শুনুন দয়া করে”।
নন্দিনী দেবীর চোখ গুলো যেনো আগুনের মতো জ্বলে উঠলো। উনি রাগে গর্জে উঠলেন,
-” কিসের অন্যায়? নিজের ছেলের সুস্থতার জন্য একজন মা সব কিছু করতে পারে। আমাকে এক সিদ্ধ পুরুষ বলে গেছেন আমি যদি বারোটা অমাবস্যায় বারোটা নরবলি দিই তাহলে সোমু সুস্থ হয়ে উঠবে। ও হেঁটে চলে বেড়াবে। একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে জীবন কাটায় সেভাবেই কাটাতে পারবে। আগের জনকে হাঁড়িকাঠে নিয়ে আসার আগেই সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিলো ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে। পাশের বাড়ির ওই লোকটা চিৎকার করছিলো সেটা দেখে তাই লোক জড়ো করে ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে যায়। আর তারপর থেকে এখানের কেউ আমাদের ভালো চোখে দেখে না তাই বাধ্য হয়ে কলকাতায় বিজ্ঞাপনটা দিতে হয়েছিলো।”
আমি কথা গুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেছিলাম।অতিরিক্ত মাতৃস্নেহ আর মনের কুসংস্কার ওনাকে অমানুষ বানিয়ে দিয়েছে। ওনার চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। উনি বলে চলেন,
” আজ অমাবস্যা। আজই তোকে বলি দেবো। তাহলেই আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।”
এই কথা গুলো বলেই উনি খাঁড়াটা আমার দিকে তুলে ধরলেন। পাশের লোকদুটো আমার দিকে তাকিয়ে যেনো পিশাচের মত হাসছে। নিজের এই ভয়ংকর পরিণতি দেখার আগে আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান যখন ফিরল তখন আমি একটা অচেনা বাড়িতে কারোর একটা বিছানায় শুয়ে। আমার সামনে বসে আছেন সুজয় বাবু। উনি আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে বললেন,
-” আপনার আর কোনো ভয় নেই। আপনি আমার বাড়িতে। পুলিশ ওই মহিলা আর তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করেছে। আমি ছাদে ছিলাম তখন। আপনার চিৎকার শুনেই বুঝেছিলাম কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। অনেক দিন ধরে ওই বাড়িতে অনেক কিছু চলছে। আপনার আগের লোক টা ছাড়া আর সবাই কে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি কিন্তু কোনোদিন বাড়ির বাইরে যেতে দেখিনি। সন্দেহ ছিল কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারি নি আর পুলিশও আমার কথা বিশ্বাস করত না। তাই অপেক্ষা করতাম একটা প্রমাণের। কাল রাতে সেই সুযোগ পেয়ে যাই এবং পুলিশকে ফোন করি সঙ্গে সঙ্গে। ওনারা এসে আমার সাথে ওই ঘরে যায় আর ওদের গ্রেপ্তার করে। আমি খেয়াল করি আপনি ওই ভাবেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। আমি আপনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসি।”
কথা গুলো শুনে আমি নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করি,
-” আর ওর স্বামীর কি হল? সেও তো সমান দোষী।”
সুজয় বাবু হেসে বললেন,
-” ওই স্বামী এবার আর সঙ্গ দিতে চায়নি। সে বলেছিলো সে আপনাকে নাকি সব সত্যি কথা জানিয়ে দেবে তাই তাকেও মরতে হয়েছে। আর খুন টা ওনার স্ত্রীই করেছেন। পেছনের বাগানে পুঁতে রেখেছিলো ওনার দেহটা। পুলিশের জেরায় ওই মহিলা সব কিছু স্বীকার করেছেন। একটা আস্ত মানসিক ভারসাম্যহীন প্রতিবেশীর সাথে বাস করছিলাম এত দিন।আপনি বরং এখন বিশ্রাম করুন। আমি আসছি। আর আপনার ফেরার ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি। কাল সকালের ট্রেনে আপনি কলকাতা ফিরে যাবেন। আর একটা কথা ভবিষ্যতে কোনো কাজ করার আগে একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন। চলি।”
আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-” আচ্ছা, ওই বাচ্চা ছেলেটার কি হল? সে কোথায় এখন?”
উনি হেসে বললেন,
-” ওর মামা এসেছে সকালে। শুনলাম শিলিগুড়ি নিয়ে চলে যাবেন আর ওখানেই ওর চিকিৎসা চলবে। ওর ডাক্তার সে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। ওসব কথা এখন বাদ দিন। আপনি বিশ্রাম করুন। কাল আপনাকে আবার ফিরতে হবে। আমি পরে আসব আবার।”
উনি চলে যাবার পর ঘরে একরাশ নিস্তব্ধতা যেনো ছেয়ে গেলো আর তার সাথে মিশে গেলো আমার দীর্ঘশ্বাস।
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Trisha Laha |
Narrator | Souradip Roy |
Intro & Ending | Olivia Das |
Characters | Name |
---|---|
Barun Gupta | Souradip Roy |
Nandini Sannyal | Olivia Das |
Akhilesh Sannyal | Suman Sadhukhan |
Samudra Sannyal | Snehangshu Paramanik |
Sujoy Mitra | Debanshu Ghosh |
Others voice | Souradip Roy, Joydeep Lahiri |
Find us on Facebook – click here