ঈশ্বরের প্ল্যান

Views: 2
ঈশ্বরের প্ল্যান:
হলদিয়া বন্দর থেকে একটা জাহাজ ছাড়ল, এ বন্দর সে বন্দর করে যাবে, ইংল্যান্ড। এই জাহাজে আছেন ফাদার যোশেফ। ইনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়াস চার্চের সর্বময় কর্তা আর ফাদার নাম্বার one, ফাদার যোশেফ অকৃতদার। বাড়ি এঁনার ইংল্যান্ডে। বাড়িতে আছেন ছোট ভাই, ভাই-এর স্ত্রী এবং ভাই এর দুটি ছেলে মেয়ে। তাদের বছরে ২5 শে ডিসেম্বর ওখানে থাকতেই হয়। বছরে একবার ফাদারকে যেতেই হবে। অন্য বছরে প্লেনেই যান। এবার হাতে একটু সময় থাকার জন্য জাহাজে যাবার শখ। আজ ২রা ডিসেম্বর, জাহাজে দশ/ বারো দিন লাগবে। আবহাওয়া ভাল থাকলে। শীতকাল মনে হচ্ছে আবহাওয়া ভালই থাকবে।
সুন্দর সকালে জাহাজ ছেড়ে-দিল, কত লোক নামবে, কত লোক উঠবে। কত রকমের ব্যবসা বানিজ্য হবে। নীল সমুদ্রের মধ্যে তর তর করে এগিয়ে চলে জাহাজ ডোনা।
ডেকে দাঁড়িয়ে অনেক লোক। কত ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ছোটাছুটি করে খেলাধুলা করছে। কেউ দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য্য দেখছে, কেউ আবার গল্প করছে। আবার কেউ, কেউ জিনিস পত্র গোছাচ্ছে।
আমাদের ফাদার যোশেফ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইবেল পড়ছেন।12 টা বাজতেই খাবারের ঘণ্টা পড়লো, লাঞ্চ হবে। কেউ কেবিনে বসে খাবে, কেউ খাবারের ঘরে গিয়ে ডিনার টেবিলে বসে খাবে। কত রকমের লোক। কত রকমের খাবার।
ফাদার যোশেফ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন নিজের কেবিনের দিকে। তাঁর খাবার কেবিনেই আসবে। জাহাজে গেলে প্রথম প্রথম কারো মাথা ঘোরে। বমি হয়। এমনকি জ্বরও পর্যন্ত্য হতে পারে। তার জন্য সবাই নিজস্ব অর্থাৎ নিজেরাও কিছু ওষুধ বহন করে। আবার জাহাজেও উষুধ ডাক্তার সব ব্যবস্থা আছে। ফাদার যোশেফ-এরও প্রথম দুদিন একটু মাথা ঘুরছিল। একটু আধটু ও ওষুধ খেতে এখন ঠিক
আছেন। ভাল ভাবেই পাঁচ দিন কাটলো। ফাদার যোশেফের বই পড়ে, নিজস্ব ডায়েরী লিখে বেশ সময় কেটে যাচ্ছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই দেখে দেখে জল। মন হয়েছে বিকল। ততই ডেকে ভীড় বাড়ছে। গল্প গুজব করা, ছোট ছোট পার্টি করা। কিংবা নাচের আসর বসানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে কারো কেবিনে একা একা থাকতে ভাল লাগছে না। গভীর রাত অবধি আড্ডা চলে। একে অপরের সাথে পরিচয় হয়।
ফাদার যোশেফের সাথেও অনেকের পরিচয় হয়েছে। কেউ কেউ ফাদারের কাছে বাইবেল পর্যন্ত্য শুনতে আসে এমত অবস্থায় একদিন দুপুরের দিকে আকাশে মেঘ দেখা দিল। সবাই এর চোখ পড়ল। কারো মুখে চিন্তার ভাঁজ , কারো মুখে উড়িয়ে দেবার সাহস। কিন্তু চোখ সাবার আকাশের দিকে।
দেখতে দেখতে সত্যি মেঘ ছেয়ে ফেলল। গোটা আকাশ। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। ঠান্ডা হাওয়াও বইতে লাগল। কিছু ক্ষণ পরে সে এক ফোঁটা দুফোঁটা শুরু হল। একে এ শীত কাল, তার ওপর বৃষ্টি। যার সবাই কেবিনে ঢুকে পড়লো।দরজা জানালা বন্ধ।
বৃষ্টির তোড় বাড়তে লাগল।
ঘণ্টা দুয়েক পর ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬ টা। হঠাৎ প্রত্যেক জায়গায়, এমনকি কেবিনে কেবিনে বিপদ ঘণ্টা বেজে উঠল। সবাই ভয়ে আঁৎকে উঠল। যে যার ইষ্ট দেবতাকে ডাকতে লাগল। তবুও সবাই কেবিনের বাইরে এলে, জাহাজের ক্যাপ্টেন চেঁচিয়ে মাইক মুখে নিয়ে বলতে শোনা গেলো,
-“বড় বিপদের মুখে পড়ার আগে আমি সবাই কে অনুরোধ করছি। আপনারা সবাই লাইফ বোটে উঠুন। কাছাকাছি বন্দরের সাথে যোগাযোগ করেছি। অন্য জাহাজ তারা পাঠাচ্ছেন। এ জাহাজে জল ঢুকতে আরাম্ভ করেছে। নিচে কিছুর সাথে আঘাত-এ জাহাজ ভেঙ্গে গেছে। আপনার। দয়া করে সবাই লাইফ বোটে উঠুন।”
দেখা গেল প্রায় কুড়ি পঁচিশাটা- লাইফ বোট জলে নামাচ্ছে, অন্য নাবিকরা। ফাদার যোশেফ, বাইরে বেরোননি। ঘরে বসে বাইবেল পাঠ করছিলেন। অনেকক্ষণ পরে উনি কেবিনের বাইরে বেরোলেন।
তখন বৃষ্টি পড়া একটু বন্ধ হয়েছে। কিন্তু প্রচন্ড হাওয়া দিচ্ছে। বাইরে এসে দেখেন, জাহাজের প্রায় সব যাত্রীই লাইফ বোটে উঠেছে; এক-একটা বোটে- এক-একজন নাবিক। ক্যাপ্টেন জাহাজের ছাদে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।
ফাদার যোশেফ কে দেখে ক্যাপ্টেন বললে,
-” yes Father আপনি কেন ওদের সাথে চলে চলে গেলেন না?”
হেসে ফাদার যোশেফ বললেন,
-” আপনি যেমন সবাইকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে কর্ম করছেন। আমি তেমন সবাই-এর হয়ে ঈশ্বরকে র ডাকতে ব্যস্ত,সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত।”
হা-হা করে হেলে ক্যাপ্টেন বলেন,
-” একটা Good news কি জানেন ফাদার দূরে তীরের দেখা মিলেছে ডান দিকে……”
কথা শেষ হলনা ক্যাপ্টেনের; প্রচন্ড জোরে একটা ধাক্কায় দুজনে ছিটকে পড়লেন দুদিকে। আস্তে আস্তে জাহাজটা ডুবে যেতে লাগলো জলের অতলে।
ফাদার যোসেফ ছিটকে জলে পড়ে প্রথমে ডুবে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে ভেসে উঠে সাঁতার কাটতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন এর শেষ কথাটা মাথায় আছে ডান দিকে তীরের আশা আছে, তাই প্রাণপনে তিনি সাঁতার কাটেন। অনেকক্ষণ পর একটা শক্ত মতন কি যেন আঁকড়ে ধরলেন। কোনরকমে শরীরটা তার ওপর দিয়ে এলিয়ে পড়লেন। প্রচন্ড ক্লান্তিতে আর বিষণ্নতায় জ্ঞান হারালেন।
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়েছিলেন তা ঠিক করা মুশকিল। যখন তাঁর জ্ঞান ফেরে অখন দেখেন একটা তীরে এসে আক আটকে গেছেন। মাথা তুলতে পারছেন না। এত যন্ত্রনা, তবুও কষ্ট করে মাথা উঠে বসলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখেনএকটা তীর বটে। তবে জনমানবহীন। চারিদিকে নারকেলের গাছ। ভেতরে ভেতরে আরো জঙ্গল, আবার শুয়ে পড়লেন তিনি চরার ওপর। মাথায় কিছুই আসছে না। এটা কোথায়? কিভাবে এখান থেকে যাবেন? কি খাবেন? কোথায় থাকবেন? আজ কত তারিখ? কতদিন জলে ভেসে ছিলেন? নাঃ ভেবে কিছু কুলকিনারা পাচ্ছেন না। আসার সময় ঠান্ডার জন্য জামা কোট-এর ওপর চাদরও গায়ে দিয়েছিলেন। এখন ভারি ভারি লাগতে দেখেন কোট চাদর সব ভিজে ঢোল হয়ে ভারি লাগছে। একে একে সব খুলে রোদে মেলে দিলেন। ছায়া দেখে বুঝলেন দুপুর 12/ সাড়ে বারোটা বাজে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কি খাওয়া যায়? আস্তে আস্তে পায়ে পায়ে জঙ্গলের দিকে এগোলেন। কতক্ষন ঘোরা ঘুরি করার পর কিছু নাম না জানা ফল পেলেন। তবে সুমিষ্ট। দুটো নারকেল। যাই হোক যেভাবেই হোক, আজকের মত খিদে মেটাতে হবে এতেই।
সন্ধ্যে হয়ে গেল। এবার? রাত কাটবে কিভাবে? এই ঠান্ডার মধ্যে? অনেক ভেবে ফাদার যোশেফ জঙ্গলে ঢুকে একটা মোটা বড় গাছ দেখে চড়ে বসলেন। জামা কোট পড়ে চাদরটা দিয়ে গাছের সাথে নিজেকে বেশ করে বাঁধলেন, যাতে ঘুমিয়ে পড়লে পড়ে না যান। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত শরীরটা গাছের মধ্যে এলিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়লেন। সকালে ঘুম ভাঙতেই গাছের আরো উঁচু ডালে উঠে হাওয়ায় চাদরটা ওড়াতে লাগলেন। যদি কোনো জাহাজ বা মাছ ধরার ট্রোলার- এর দেখা পান বা তারা যদি দেখে এখানে কেউ চাদর ওড়াচ্ছে ; যদি আসে। কিন্তু হায় – ঈশ্বর। এইভাবে দুদিন কেটে গেল, ফাদার যোশেফ ভেঙ্গে পড়লেন না।ই বেলা বাইবেল আওরান। আর মনে মনে ডাকেন
-“হে ঈশ্বর, দিক দেখাও। আর বেশ কি কোন আশা ভরসা আছে। কি করবো? এত তোমায় ডাকি, আমার ডাক কি তোমার কানে পৌঁছোয় না। কি পাপ করেছিলাম যে এতো শাস্তি দিচ্ছো। হে ঈশ্বর, পথ দেখাও। মনে বল যোগাও।”
পরের দিন একটু দূরে হাত ১৫ দূরে একটা ছোট টিলা আছে। কি ভেবে ফাদার যোশেফ, নারকেল গাছের পাতা, অন্য গাছের ডাল নিয়ে ঐ টিলার মাথায় একটা ঝুপড়ি মতন ঘর করলেন। বেশ শক্ত পোক্তভাবে। আর এই টিলার থেকেও সমুদ্রর অনেক খানি দেখা যায়। এইভাবে আরো আগে একদিন কাটলো। ফাদার যোশেফের শরীর আর বইছে না। অর্ধহারে নারকেলের জল খেয়ে। নোনা জল খেয়েও শরীর বেশ খারাপ। তবে কি ইশ্বর এটাই চান, তাঁর জীবন অবসান এখানেই হোক। জানি না ওঁর মনে কি আছে? বেশ তাই হোক। ৫ দিনের দিন সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি হলে তো মুশকিল। ঘর তো ঝড়ে জলে ভেসে যাবে। কোন দিকে গ্রাহ্য না করে ফাদার চললেন জঙ্গলের দিকে। যেন একটা নেশার মতন। রোজ সকালে উঠেই জঙ্গলে যাওয়া, যেন জঙ্গল ডাকে।
খুব বাজ পড়ছে। বৃষ্টি নেই কিন্তু আকাশ ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এটা সেটা ফল যোগাড় করে ঘরে ফিরতে দুপুর হয়ে গেলো। ক্লান্ত হয়ে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন।একটু হাঁফ ছেড়ে আবার ঐ ৭ ফুট টিলার ওপর উঠতে হবে। যাইহোক একটু বিশ্রাম নিয়ে টিলারের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালেন। কোন রকম উলতে টলতে টিলারের ওপর উঠতে লাগলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল তাঁর অত কষ্টের ঝুপড়ি ঘরটা জ্বলছে। হাওয়ায় যেন আরো দাউ দাউ করে জ্বলছে। ছুট্টে উঠে গেলেন ফাদার। দু হাত এ মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। হা ঈশ্বর শেষ সম্বল, এইটুকু ঘরও তুমি কেড়ে নিলে। এই তোমার বিচার।
হঠাৎ ফাদারের কানে একটা আওয়াজ এলা, কে যেন বলেছে
-” হল্ট হল্ট”
ইংরজিতে বলছে,
-“কেউ-আছো? কেউ আছো? সাহায্যের জন্য এসেছি।”
মানুষের কন্ঠস্বর। চমকে উঠেন ফাদার। চিৎকার করে বলেন,
-“Oh yes yes, I am hear,”
বলেই ফাদার কোট জামা তো গায়েই ছিল। চাদরটা নিয়েই পড়িমরি করে টিলার থেকে নেমে দেখেন; জলের কিনারায় একটা বোট। তাতে তিনজন লোক। নাবিক বলেই মনে হয়। কোনদিকে না তাকিয়ে ফাদার ছুট্টে ওদের বোটে গিয়ে উঠলেন।
বোট এগিয়ে চলল, প্রায় মাঝ সমুদ্রে, একটা বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে। সেখানে বোটটা যেতেই ওপর থেকে দড়ির মই ফেলে দিল। নাবিকদের সাহায্যে ফাদার কোনরকমে ওপরে উঠে গেলেন। ডেকের ওপর উঠে পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন। একটা নাবিক মুখের সামনে কি বলতে ফাদার বলে ওঠেন,
– “ওয়াটার- ওয়াটার।”
একজন এক জগ জল নিয়ে এসে দিল। ফাদার সেটা ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন। ফাদার এর বুকের জামাটা খোলা ছিল। তার গলায় যীশুর বড় লকেটওয়ালা হার ঝুলছিল। সেটা দেখেই সামনা সামনি যত নাবিক ছিল সবাই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন এল। ফাদার কে দেখে ইংরাজিতে বলল,
-“Are you Father?”
ফাদার যোশেফ মাথা নাড়েন; ক্যাপ্টেনও হাত জোড় করে নমস্কার করে।
এবার ফাদার যোশেফ ইংরাজিতে বলেন,
-” আমার সন্ধান তোমরা কি করে পেলে?”
ক্যাপ্টেন ইংরাজিতে বলেন,
– “ ফায়ার সিগন্যাল দেখে আমরা বুঝলাম এখানে কোন মানুষ আটকা পড়েছে। তাই গেলাম। আপনি কোথায় যাবেন?”
ফাদার যোশেফ বলেন,
– ” আমি ইংল্যান্ড যাবো। আচ্ছা আজ কত তারিখ?”
ক্যাপ্টেন বলেন,
-” ২৩ শে ডিসেম্বর। ইংল্যান্ডে আপনি ২৪ শে পৌঁছে যাবেন।”
ফাদার যোশেফের চোখে জল ভরে আসে। বুকে ক্রুশ এঁকে বলেন,
-” হে ঈশ্বর তুমি সত্যি মঙ্গলময়, ঘর-এর আগুনের সত্যি মহিমা অপার, সত্যি তুমি বড় প্ল্যানার। শত কোটি প্রণাম তোমায়। সত্যিই God is Good.
Audio Story Starts From Here:
Story Info | Name |
---|---|
Writer | Kaberi Ghosh |
Intro & Ending | Debanshu Ghosh |
Kathak | Olivia Das |
Characters | Name |
---|---|
Father | Joydeep Lahiri |
Captain 1 | Suman Sadhukhan |
Captain 2 | Soumik Banerjee |
Find us on Facebook – click here